• বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৫ ১৪৩১

  • || ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook
সর্বশেষ:
মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ইতিহাসে অনন্য: রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিরা হস্ত‌ক্ষেপ করবে না: ওবায়দুল কাদের লালমনিরহাটে যুবলীগ কর্মীর পায়ের রগ কাটলেন যুবদল নেতা বাসার ছাদ থেকে পড়ে যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু ঠাকুরগাঁওয়ে ঈদ-নববর্ষে ১০ জন নিহত, আহত ২ শতাধিক

মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা ‘ক্রিকেটার’ বীথির সাফল্যের পেছনের গল্প 

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৬ অক্টোবর ২০২১  

Find us in facebook

Find us in facebook

ক্রিকেটার, ক্রিকেট প্রশিক্ষক, ক্রিকেট একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা, স্বেচ্ছাসেবী, অক্সিজেন লেডি- যার নামের পাশে এত এত অর্জন তিনি আরিফা জাহান বীথি। দারিদ্র্যের বেড়াজাল ভেঙে বীথির একের পর এক সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার পেছনের গল্পটা উৎসাহ দিয়েছে তার মতো আরো অনেক নারীকে। যার ফলস্বরূপ বীথি পেয়েছেন ইন্সপায়ারিং ওমেন ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড।

করোনাকালে স্বাস্থ্য-সচেতনতা বৃদ্ধি, খাদ্য বিতরণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গত ১৩ অক্টোবর এ সম্মাননা তুলে দেওয়া হয় আরিফা জাহান বীথির হাতে।

আরিফা জাহান বীথির উঠে আসা
রংপুর নগরীর নূরপুরের দরিদ্র পরিবারের মেয়ে বীথি চার ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়। দারিদ্র্যের বেড়াজালের মাঝেই তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। স্বপ্ন পূরণ তো দূরের কথা, মৌলিক চাহিদা পূরণ করাও বীথির পরিবারের জন্য ছিল কষ্টসাধ্য। যা ধীরে ধীরে তাকে নিয়ে যেতে থাকে আত্মহত্যার মতো অপরাধের দিকে। কিন্তু বীথিকে সে অপরাধ করতে দেননি মা ও বড় বোন। তাকে ফিরিয়ে এনেছেন মৃত্যুর মুখ থেকে, দিয়েছেন উৎসাহ।

শুরু হয় বেঁচে থাকার নতুন সংগ্রাম। বাড়ির সামনেই মায়ের সঙ্গে মুদি দোকান দিয়ে শুরু করেন পথচলা। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে বড় ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন বীথি। এক পা-দু পা করে সে পথেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। স্থানীয় এক কোচের অধীনে ক্রিকেট প্রশিক্ষণও নিতে শুরু করেন। কিন্তু আরিফা জাহান বীথিকে স্বপ্ন পূরণ করতে দেয়নি ইনজুরি। নাকের সমস্যায় ছিটকে পড়েন তিনি। তবে ক্রিকেটার হতে না পারলেও থেমে থাকেননি। নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে স্বপ্ন দেখিয়েছেন আরো অনেক নারীকে। গড়ে তুলেছেন দেশের প্রথম নারীদের ক্রিকেট একাডেমি। বীথির উঠে আসার শুরুটা সেখান থেকেই।

২৩ বছর বয়সী বীথির একাডেমির নাম ‘ওমেন’স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি’। সেখানে কোনো ধরনের ফি ছাড়াই ক্রিকেট প্রশিক্ষণ নিতে পারে মেয়েরা। ২৫০ জন অদম্য তরুণীকে নিয়ে একাডেমির সবুজ ঘাসে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি। ক্রিকেট প্রশিক্ষণের পাশপাশি সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন আরিফা জাহান বীথি। করোনা পরিস্থিতিতে অক্সিজেন ও খাবার নিয়ে দাঁড়িয়েছেন অসহায় ও অন্তঃসত্ত্বাদের পাশে। ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবে দরিদ্র্যদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন খাবার। বর্তমানে নিয়মিত অসহায় মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন বীথি।

বীথির হাত ধরেই দেশের প্রথম নারী ক্রিকেট একাডেমি            
২০১০ সালে রংপুর জেলার হয়ে ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নেন বীথি। ওপেনিংয়ে ভালো করায় ঢাকার ক্রিকেটেও চলে আসেন তিনি। খেলেছেন ওরিয়েন্ট স্পোর্টিং ক্লাব, লেজেন্ড অব ভাওয়াল ক্রিকেট একাডেমি, ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট একাডেমি ও রায়েরবাজার অ্যাথলেটিক ক্লাবের হয়ে। ক্রমাগত ভালো খেলতে থাকায় বীথির লাল-সবুজ জার্সি গায়ে জড়ানোর স্বপ্ন হাতের মুঠোয় চলে আসে। কিন্তু সেই সময় বাধা হয়ে আসে শারীরিক অসুস্থতা।

২০১৭ সালে উইমেন’স প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ চলাকালে অপ্রত্যাশিতভাবে নাকের ইনজুরিতে পড়েন। নাক থেকে ঝরতে থাকে রক্ত। চিকিৎসা চালিয়ে গেলেও বীথির নাক থেকে রক্তপড়া সারেনি। একসময় জানতে পারেন, ক্রিকেট খেলা না ছাড়লে তার ৮০ শতাংশ ক্যান্সার হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ফলে বাধ্য হয়েই জলাঞ্জলি দেন ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন। 

ক্রিকেটার হতে না পারলেও খেলা থেকে দূরে যেতে পারেননি বীথি। নিজেকে তৈরি করেন নতুন করে। এবার আত্মপ্রকাশ করেন প্রশিক্ষক হিসেবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাংলাদেশ হুইলচেয়ার নারী ক্রিকেট টিমের ছয়দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে কোচিং জীবনের শুরু। এরপরই মাঠের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে উত্তরাঞ্চল থেকে সম্ভাবনাময় নারী ক্রিকেটার তৈরির লক্ষ্য নিয়ে গড় তোলেন নারী ক্রিকেট একাডেমি।

২০১৯ সালের ২৬ অক্টোবর ৩০ জন প্রশিক্ষণার্থী নিয়ে ক্রিকেট একাডেমির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেন আরিফা জাহান বীথি। নিজের জমানো ১০ হাজার ও এনজিও থেকে মায়ের ঋণ নেয়া ২০ হাজার টাকায় প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য ব্যাট, বল, প্যাড, হেলমেটসহ ক্রিকেটের সব সামগ্রী কেনা হয়। বর্তমানে বীথির ক্রিকেট একাডেমিতে বিনামূল্যে ক্রিকেট প্রশিক্ষণ নিচ্ছে ২৫০ জন তরুণী। এখান থেকে চলতি বছর ১১ জন ক্রিকেটার বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) পরীক্ষা দিয়ে আটজন টিকে যায়। তারা সবাই নিম্ন আয়ের এবং অসচ্ছল পরিবারের মেয়ে। 

স্বেচ্ছাসেবা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে বীথি
নারী ক্রিকেটার তৈরির পাশাপাশি অসহায়-অসচ্ছলদের জন্যও কাজ করেন আরিফা জাহান বীথি। করোনাভাইরাসে প্রকোপ শুরুর পর রংপুরের চরাঞ্চলসহ দুর্গম এলাকাগুলোতে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের জন্য খাবার নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন সাবেক এ ক্রিকেটার। ঐ সময় প্রায় চার হাজার অন্তঃসত্ত্বার বাড়িতে নানারকম পুষ্টিকর খাবার পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার তামিম ইকবাল, রুবেল হোসেন, কোচ ফাহিম আবেদীনসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ কাজে বীথিকে সহযোগিতা করেছেন।

দেশে করোনা পরিস্থিতি যখন সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় তখনো অসহায় মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাননি বীথি। বিভিন্ন সময় নিজ উদ্যোগে অক্সিজেন সংগ্রহ করে নিজ জেলার অসহায় করোনা রোগীদের সাহায্য করেছেন। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুবিধাবঞ্চিতদের সাহায্যে ছুটে গেছেন দিন-রাত। সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে এমন সাহসী ভূমিকা পালনের জন্য আরিফা জাহান বীথিকে দেওয়া হয়েছে ‘অক্সিজেন লেডি’ সম্মান।

করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতার মধ্যেও গত ঈদুল আজহায় তিনটি গরু কোরবানি দিয়ে ৭০০ পরিবারের মাঝে বিতরণ করেছেন সাবেক ক্রিকেটার আরিফা জাহান বীথি। ঈদের দিন দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত রংপুর নগরীর ঘনবসতিপূর্ণ নূরপুর, মহাদেবপুর, লালবাগ রেলস্টেশন, আদর্শপাড়া, মণ্ডলপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় অসহায়-দুস্থ, কর্মহীন, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারে কোরবানির মাংসের প্যাকেট বিতরণ করেন তিনি।

গত রমজানেও অসহাদের হাতে ইফতার তুলে দিয়েছেন আরিফা জাহান বীথি। এছাড়া ২৫ জন অসহায় নারীকে সেলাই মেশিন দিয়ে স্বাবলম্বী করেছেন। গৃহহীন ১০টি পরিবারকে দিয়েছেন নতুন ঘর। সহায়-সম্বলহীন ২১ জন শিক্ষার্থীকে কলেজে ভর্তির জন্য আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন।

ইন্সপায়ারিং ওমেন ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২১ অর্জন
নারীদের জন্য বিনামূল্যে ক্রিকেট প্রশিক্ষণের আয়োজন, করোনা পরিস্থিতিতে সাহসী ভূমিকা পালন, বিভিন্ন সময় খাবার-ওষুধ নিয়ে হাজারো অসহায়-দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ‘ইন্সপায়ারিং ওমেন ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২১’ সম্মাননা দেওয়া হয়েছে ক্রিকেটার আরিফা জাহান বীথিকে।

ইউএনভি বাংলাদেশ, ভিএসও বাংলাদেশ, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এবং অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ যৌথভাবে এ সম্মাননার আয়োজন করে। বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এলজিএইডি ভবনে বীথির হাতে এ সম্মাননা তুলে দেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সুলতানা আফরোজ।

এখনো অসংখ্য অসহায় মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন আরিফা জাহান বীথি। একই সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন ক্রিকেটার তৈরির কাজও। সব মিলিয়ে স্বপ্নপূরণের পথে বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সামগ্রিক বিষয় নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।

আরিফা জাহান বীথি বলেন, চলতি মাসেই ‘উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি’র দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আমরা একটি টুর্নামেন্টের আয়োজন করছি। এখানে একাডেমিসহ সারাদেশ থেকে ৯০ জন নারী ক্রিকেটার অংশ নিচ্ছে। দেশের ছয়জন নারী ব্যক্তিত্বের নামে চারদিনের এ টুর্নামেন্টে খেলবে ছয়টি দল।

তিনি আরো বলেন, করোনা পরবর্তীতে অনেক শিক্ষার্থী অর্থাভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে না। আমরা তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছি। এছাড়া অসহায়-বিধবা নারীদের প্রশিক্ষণ ও সেলাই মেশিন দিয়ে স্বাবলম্বী করা হচ্ছে। আগামীতেও আমরা এ ধরনের স্বেচ্ছাসেবা অব্যাহত রাখতে পারব বলে আশা করছি।

প্রয়োজনের মুহূর্তে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বীথি বলেন, কারো অসুবিধার কথা শুনলে চুপ করে থাকতে পারি না। আবার সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে সহযোগিতাও করতে পারি না। আমার ফেসবুক পোস্টে সাড়া দিয়ে যারা প্রতিনিয়ত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আগামীতেও সবাইকে এভাবেই পাশে নিয়ে অসহায়দের উপকার করে যেতে চাই।

Place your advertisement here
Place your advertisement here