• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

Find us in facebook

ইউটিউব বদলে দিয়েছে মা-ছেলের জীবনের গল্প

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৬ এপ্রিল ২০২২  

Find us in facebook

Find us in facebook

যে মা তার সন্তানের মুখে এক বেলা ভাত তুলে দিতে বাড়ি বাড়ি ছুটে বেড়িয়েছেন, এখন সেই মা-ই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের অনাহারি-অর্ধাহারি মানুষের মুখে তুলে দিচ্ছেন উন্নত খাবার। শুধু তা-ই নয়, মা-ছেলে মিলে কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ জীবনসায়াহ্নে সেবাবঞ্চিতদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম গড়ার স্বপ্নও দেখছেন। নিজেদের জীবনে দুঃখ-কষ্টের হলেও সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের পাশে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন নাহার বেগম ও তার ছেলে কামাল আহমেদ। তাদের বসবাস রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বালুয়া মাসিমপুর ইউনিয়নের হামিদপুর গ্রামে।

কিন্তু এই যাদের অবস্থা, তাদের আয়ের উৎস কী? মা-ছেলের রয়েছে ‘ভিলেজ কুকিং কামাল বিডি’ নামের ইউটিউব চ্যানেল। ইউটিউব থেকে আয়ের টাকায় বদলে গেছে মা ও ছেলের জীবনের গল্প। সেই আয়ের টাকায় মানবিক কাজে অংশ নেন তারা। ইউটিউব চ্যানেলের কনটেন্ট তৈরিতে যে খাবার রান্নাবান্না করেন মা ও ছেলে, বিনামূল্যে তা খাওয়ান গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের। পাশাপাশি বিনোদনমূলক বিভিন্ন কনটেন্ট তৈরি করে ইউটিউবে আপলোড করেন। সে আয়ের টাকায় গ্রামের মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতাও করছেন। এতে মানুষের প্রশংসায় ভাসছেন মা ও ছেলে।

জানা যায়, আড়াই বছর আগে মা নাহার বেগমের পরামর্শে ইউটিউবের জন্য কনটেন্ট তৈরির কাজে মনোনিবেশ করেন কামাল আহমেদ। সে মোতাবেক তৈরি করেন ইউটিউব চ্যানেল ভিলেজ কুকিং কামাল বিডি। অল্প সময়ের মধ্যেই চ্যানেলটি জনপ্রিয়তা পায়। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। খাবার তৈরির ভিডিও ছাড়াও বিনোদন ও সচেতনতামূলক বিভিন্ন কনটেন্ট তৈরি করে নেটিজেনদের মন জয় করে চলেছেন কামাল। প্রতিদিনই ইউটিউবে তার ফলোয়ার সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে ‘ভিলেজ কুকিং কামাল বিডি’ চ্যানেল ছাড়াও কামালের রয়েছে আরও সাতটি চ্যানেল। এসব থেকে বছরে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা আয় করছেন মা ও ছেলে।

সম্প্রতি বালুয়া মাসিমপুরে ঘুরতে গেলে দেখা যায়, সেখানকার হামিদপুর তালতলা কওমি মাদরাসা প্রাঙ্গণে তারা নতুন কনটেন্ট তৈরির আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ তাদের রান্নাবান্নার কাণ্ড দেখে যে কারও মনে হতে পারে বিয়েবাড়ি বা বড় কোনো আয়োজনের জন্য এত দৌড়ঝাঁপ চলছে। কিন্তু আসলে তা নয়, মাদরাসার এতিম ও অসহায় ছাত্রদের বিনামূল্যে খাওয়ানো এবং তার ভিডিও ধারণের জন্যই ছিল এই কর্মযজ্ঞ।

প্রথমে বাজার ও রান্না করে গ্রামের অনাহারি ও অর্ধাহারি মানুষদের খাওয়ায়। বাজার করা, রান্না এবং খাওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি পদক্ষেপের ভিডিও ধারণ করে তা ইউটিউব চ্যানেলে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে দর্শকদের ব্যাপক সাড়া মেলার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয় আয়ের উৎস। এরপর ইউটিউব থেকে আয়ের টাকা দিয়ে বারবার মানুষকে বিনামূল্যে খাওয়ানো এবং ভিডিও ধারণ করে তা ইউটিউবে ছেড়ে দেওয়ার কাজ চলতে থাকে কামালের। প্রায় সাত মাস ধরে এভাবেই মিঠাপুকুর ও পার্শ্ববর্তী উপজেলা পীরগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে অসহায়, দুস্থ ও নিম্ন আয়ের মানুষকে বিনামূল্যে খাওয়ানোর সঙ্গে নিজেদের কনটেন্ট তৈরির কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করে আসছেন কামাল ও তার সঙ্গীরা। এতে প্রতিমাসে ইউটিউব থেকে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা আয় করছেন তারা। ইউটিউব চ্যানেলে কাজ করে আট সদস্যদের একটি দল। প্রত্যেককেও প্রতি মাসে বেতন দেন মা-ছেলে।

স্থানীয়রা বলছেন, ইউটিউবের আয়ের টাকা থেকে গ্রামের অনাহারি-অর্ধাহারি মানুষকে একসঙ্গে খাওয়ানোর বিষয়টি সবার কাছে সাড়া ফেলেছে। এ ধরনের উদ্যোগ এর আগে গ্রামের কেউ নেননি। নাহার বেগম ও তার ছেলে কামালের উদ্যোগে খুশি হতদরিদ্র এসব মানুষ। প্রতি সপ্তাহে ঘটা করে খাওয়ানোর আয়োজনের পাশাপাশি বৃদ্ধাশ্রমের জন্যও তাদের প্রচেষ্টাকে মহতী উদ্যোগ মনে করছেন তারা।

হামিদপুর তালতলা কওমি মাদরাসার প্রধান শিক্ষক আকমাল হোছাইন বলেন, গরিব অসহায় মানুষদের জন্য এমন সুন্দর চিন্তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমার মাদরাসার ছাত্রদের জন্য তারা নিজেরা যেভাবে রান্না করে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছে, এ রকম আগে কেউ খাওয়ায়নি। শুধু আমার মাদরাসাতে নয়, বিভিন্ন এলাকায় ইউটিউবার কামাল আহমেদ এ ধরনের আয়োজন করে আসছেন বলেও জানান তিনি।

একই গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন বলেন, আমাদের গ্রামে অনেক বিত্তবান মানুষ রয়েছে। কিন্তু তারা কেউ এভাবে রান্না করে গরিব মানুষকে খাওয়ায় না। কামাল নিজেই অসহায় পরিবারের সন্তান। তারপরও গ্রামের মানুষকে তার ইউটিউবের আয়ের টাকা থেকে খাবারসহ বিভিন্ন সময়ে নতুন কাপড় ও আর্থিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছে।
জানা গেছে, চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় সংসার বিচ্ছেদের শিকার হন নাহার বেগম। এরপর বাবার বাড়িতে ফিরে গেলেও সেখানে বেশি দিন থাকা হয়নি তার। অভাবের তাড়নায় কাজের খোঁজে ঢাকায় পাড়ি জমান। সেখানে প্রায় ১৪ বছর পোশাক কারখানায় কাজ করেন। এরই মধ্যে কষ্ট করে ছেলে কামালকে দর্জি কাজ শেখানোর পাশাপাশি এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখাও করান। কিন্তু হঠাৎ নাহার বেগম অসুস্থ হয়ে পড়লে, তার বেশ কয়েকটি অস্ত্রোপচার করতে হয়। এ সময় চিকিৎসা খরচ বাড়তে থাকায় ফের তার জীবনে ফিরে আসে দুর্দিন।

এ রকম নাজুক পরিস্থিতিতে মায়ের পরামর্শ আর নিজের ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ইউটিউবে ঝুঁকে পড়েন কামাল। বছর দুয়েক পর গ্রামে ফিরে ইউটিউব চ্যানেল থেকে আয়ের ভিত্তিতে মা-ছেলে মিলে ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধ শুরু করেন। এরপরের গল্পটা শুধুই বদলে যাবার, বদলে দেবার।

বিশ-পঁচিশ বছর আগের কষ্টময় দিনগুলোকে অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখছেন তারা। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় কামাল আহমেদ বলেন, একসময় আমাদের ভাতের জন্য খুব কষ্ট ছিল। আমার গ্রামে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়েছিল। কেউ তাকে সহযোগিতা করেননি। অভাব-অনটনের মাঝে ২০০১ সালে মা আমাকে নিয়ে ঢাকায় চলে যান। সেখানে গার্মেন্টসে দীর্ঘ ১৩ থেকে ১৪ বছর চাকরি করেন। অনেক কষ্ট করে আমাকে পড়ালেখা করিয়েছেন। আমি দর্জির কাজ শিখে রাতে সেলাইয়ের কাজ করতাম, আর দিনে স্কুলে যেতাম। কিন্তু ঢাকা শহরে সেই আয়ে আমাদের সংসার চালানো খুবই কষ্টের ছিল।

তিনি আরও বলেন, মা অসুস্থ হন। তার তিন থেকে চারটি অপারেশন করতে হয়। এরপর মা আর কাজে ফিরতে পারেননি। তখন থেকেই মায়ের অনুপ্রেরণা ও পরামর্শে ইউটিউব থেকে আয় করার ব্যাপারটি আমার মাথায় কাজ করে। আমি কয়েক বছর ধরে ইউটিউব নিয়ে বেশ দৌড়াদৌড়ি করেছি। আল্লাহর রহমতে দুই-আড়াই বছরের মধ্যে সফলতার আসে। এ সময় আমার কিছু টাকা জমা হয়। তখনই আমি গ্রামে ফিরতে মনস্থির করি। এলাকার মানুষের পাশে থেকে কিছু করার পাশাপাশি ইউটিউবের জন্য কনটেন্ট তৈরির ধারণাটি আমার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি। এখন প্রতি মাসে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা আয় করছি।

মায়ের স্বপ্ন নিয়ে কামাল বলেন, আমার মায়ের চাওয়া স্বপ্ন গ্রামের কেউ যেন অনাহারে না থাকেন। দরিদ্র মানুষ যেন এক বেলা হলেও ভালো খাবার খায়, ভালো পোশাক পরে। আমাদের নিজেদের এখনো ঘরবাড়ি হয়নি। আমরা মা-ছেলে এখনো ভাড়া বাড়িতে থাকি। তারপরও আমার মায়ের ইচ্ছা একটা বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করার। এ জন্য ইতোমধ্যে কিছু জায়গাও আমরা কিনেছি।

নাহার বেগম বলেন, আমার বান্ধবীর ছেলেকে দেখেছি ইউটিউব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে। তখন আমার ছেলেকে আমি সেই কাজটা দেখিয়েছি। আমার বান্ধবীর ছেলে যদি ইউটিউব থেকে আয় করতে পারে, তাহলে আমার ছেলেও (কামাল) পারবে। এই বিষয়টা আমার ছেলেকে বোঝাতে পেরেছি। এরপর কামাল ইউটিউব সম্পর্কে জানতে ও শিখতে শুরু করে। এখন আল্লাহর রহমতে ইউটিউব থেকে আয় হচ্ছে।

গ্রামের মানুষদের রান্না করে খাওয়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ভাতের জন্য কী কষ্ট হয়, আমি তা জানি। আমার ঘরবাড়ি, জমিজমা নেই। এক পোয়া (২৫০ গ্রাম) চাল রান্না করে ছেলেকে নিয়ে তিন বেলা খেয়েছি। এখন আমি উদ্যোগ নিয়েছি, আমার মতো গ্রামের অসহায়, দরিদ্র মানুষের জন্য কিছু একটা করব। এখন ছেলে ইউটিউবের আয় থেকে নিজের কনটেন্ট তৈরি করার পাশাপাশি গ্রামে উন্নত খাবার খাওয়ানোর ব্যবস্থা করছে। এখন আমার স্বপ্ন একটা বৃদ্ধাশ্রম গড়ব।
###ঢাকা পোস্ট

Place your advertisement here
Place your advertisement here