• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook

বাবা ভ্যানচালক, মা বেচেন চা, মেয়ে যাচ্ছেন পর্তুগাল

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১ জুন ২০২২  

Find us in facebook

Find us in facebook

‘মেয়ে মাইনসের (মানুষের) কিসের ফুটবল খেলা। তাও আবার ছোট প্যান্ট আর গেন্জি পরিয়া। লাজ লজ্জা সব উঠে গেল। কী যুগ আসিল সব ভূলে গেল মাইলা (মেয়ে)। এই রকম সমাজের নানান জনের নানা কটু কথা প্রতিনিয়ত শুনার লাগতো।’ সঙ্গে আড় চোখে মানুষের তাকানো, আড়ালের কটু কথা। ‘কেউ কেউ আবার মুখের সামনেই-কি দরকার মেয়ে হয়ে ফুটবল খেলার’ -এভাবে বলে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দিত। মানুষের যেন নিত্য দিনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এটি। তবে থেমে থাকেননি। মানুষের কটু কথা থামাতে পারেনি সফলতার পথচলা। 

ভালো খবর হল কিছুদিন আগেও যারা কটু কথা বলতো তাদের কথার ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। যারা বলেছিল তারাই এখন নিজের সন্তানদের মেয়ে ফুটবলার বানানোর স্বপ্ন দেখছেন। একসময় যারা অপমান করতো তারা এখন আসেন পরামর্শ নেওয়ার জন্য। কিভাবে তার মত নিজের মেয়েও ফুটবলার হতে পারে।

ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার রাঙাটুঙ্গী ইউনাইটেড মহিলা ফুটবল একাডেমির সদস্য কাকলী আক্তার দেশের গন্ডি পেরিয়ে বাইরের দেশে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তিনমাস ফুটবল প্রশিক্ষণের জন্য পর্তুগাল যাচ্ছে কাকলী। এ নিয়ে এলাকাজুড়ে উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।

উপজেলার রাণীশংকৈল পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের আবুল কাশেম ও বানেসার মেয়ে কাকলী আক্তার (১৬)। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট।

নিজস্ব বসতভিটা ছাড়া আবাদি কোন জমি নেই কাকলীদের। ঋণের টাকায় একটি ভ্যান কেনেন তার বাবা। সেই ভ্যান চালিয়ে যা আয় হত তা দিয়েই চলতো ভরণপোষণ। আয়ের তুলনায় পরিবারের চাহিদা বেশি থাকতো তাদের। তবে কিছুই করার ছিল না। উপার্জন আসার কোনো রাস্তা ছিল না তাদের। যা হত কষ্ট করে নিজের সংসার চালিয়ে নিতেন কাকলীর মা বানেসা। 

দিন আসতো দিন যেত অভাব যেন দূর হতো না তাদের। মাঝখানে কাকলীর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে ফেলেন। যেন আকাশ ভেঙে পরলো তার মায়ের ওপর। এত বড় সংসার কিভাবে চলবে। অভাব আর অশান্তি দুটোই যুক্ত হলো জীবনে৷ তবে বাস্তবতাকে মেনে নিতে সংকোচ বোধ করেননি তার মা। নিজের কাছে জমানো কিছু টাকা দিয়ে শুরু করেন চা বিক্রি। রাস্তার ধারে ছোট একটি দোকানে চা বিক্রি করেই পরিবার ও কাকলীর অর্থের যোগান দিয়েছেন তিনি।

কয়েক বছর পর কাকলীর বাবা নিজ ভূল বুঝতে পরে দ্বিতীয় সংসার ছেরে আবার ফিরে আসেন তাদের কাছে। পরে সব মেনে নিয়ে আবার সংসার চলা শুরু হয় তাদের৷ বর্তমানে অসুস্থ বয়োবৃদ্ধ বাবা চালান ভ্যান আর মা করে যাচ্ছেন চা বিক্রি। তবে মেয়ের দেশের বাইরে যাওয়ার কথা যেন সব কষ্ট ভূলিয়ে রেখেছে তাদের পরিবারকে।

কাকলীর মা বানেসা বলেন, ‘মেয়েডা আমার ফুটবল খেলে। নানান জনে নানা ধরনের খারাপ কথা কহে। খারাপ লাগিলেও মেয়েডা কান্নাকাটি করতো আবার যাইতো খেলতে। নিজস্ব থাকবার জায়গা ছাড়া আর আমাদের কিছু নাই৷ স্বামী ভ্যান চালায় আর আমি চা বিক্রি করি। এখন আমার মেয়েডা বাইরের দেশত যাচ্ছে এটা গর্বের বিষয়। সবাই দোয়া করবেন তার জন্য।’ 

কাকলীর বাবা আবুল কাশেম বলেন, ‘আমি দিনমজুরি করে সংসার চালাতাম৷ পরে একটা ভ্যান নিয়ে ভ্যান চালানো শুরু করি। এখনো ভ্যান চালিয়ে সংসার চালায়। আর কাকলীর মা চা বিক্রি করে। আমি বয়সের কারণে নানারোগে ভুগি। পায়ের সমস্যা লেগেই আছে। মেয়েটা পর্তুগাল যাচ্ছে প্রশিক্ষণে এটি আমার কাছে অনেক আনন্দের। যেখানে যাই সেখানকার লোকজন খোঁজখবর নেই। চা খাওয়ায় আর কাকলীর গল্প করে। তখন বুকটা ভরে উঠে। আমার মেয়ের জন্য সকলে দোয়া রাখবেন।’

কাকলী আক্তার বলেন, স্কুল পর্যায়ে যে বঙ্গমাতা ফুটবল খেলাগুলো হত সেখান থেকেই আমার শুরু৷ পরে আমার এক স্যার বললেন আমি ফুটবলার হবো কি না। আমি বলেছিলাম যদি ভালো সুযোগ পাওয়া যায় তাহলে হবো। পরে তিনি আমাকে রাঙাটুঙ্গিতে যোগাযোগ করিয়ে দেন। আমি বাবা মাকে বিষয়টি বলি। তারা আমাকে সহযোগিতা করেছেন এবং ফুটবল কিনে দিয়েছেন। এখন দেশের বাইরে যাচ্ছি আরো উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য। এটি আসলে অনেক বড় আনন্দের খবর আমার কাছে৷ তবে এ আনন্দের পেছনে অনেক পরিশ্রম রয়েছে। মেয়ে হিসেবে ফুটবল খেলতে এসে নানা ধরনের কটু কথা শুনতে হয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে রাঙাটুঙ্গি ইউনাইটেড মহিলা ফুটবল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘অনুর্ধ-১৭ জাতীয় চাম্পিয়ানশীপ যারা হয়েছে তারা বাংলাদেশ যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ১১ জন ছেলে ব্রাজিলে  ও ১১ জন মেয়ে পর্তুগালে ফুটবল প্রশিক্ষণের জন্য যাচ্ছে৷ বেষ্ট এগারোর মধ্যে আমাদের ঠাকুরগাঁও জেলা থেকে একজন নির্বাচিত হয়েছেন৷ সে রাঙাটুঙ্গির মহিলা ফুটবলার কাকলী। সে নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তার বাবা বয়োবৃদ্ধ মানুষ। যদি বয়সের ভাড়ে ভ্যান ঠিকমতো  চালাতে পারেননা। কিন্তু সেটিই একমাত্র আয়ের উৎস তাদের। আর তার মা নিজেই চা বিক্রি করেন।’

এমন খুশির খবর শুনে রাণীশংকৈল পৌরসভার মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমার পৌরসভার এক হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান কাকলী৷ তার বাবার চেয়ে তার মা তাদের পরিবারের ভরণপোষণ চালাতো। কাকলীর মা  চা বিক্রি করে তাদের সংসারের খরচ চালিয়েছে। আজ ও ফুটবলের উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য পর্তুগাল যাচ্ছে। এটি আমাদের পৌরসভার জন্য একটি খুশির খবর।’ 

Place your advertisement here
Place your advertisement here