• রোববার   ২৬ মার্চ ২০২৩ ||

  • চৈত্র ১২ ১৪২৯

  • || ০৩ রমজান ১৪৪৪

Find us in facebook
সর্বশেষ:
জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা শ্রদ্ধা জানাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল গণহত্যার স্বীকৃতি চাইলেন সজীব ওয়াজেদ জয় মহান স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে স্পীকারের শ্রদ্ধা স্বাধীনতা দিবসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অভিনন্দন

চরের মানুষের স্বপ্ন ছুঁয়েছে ‘স্বপ্ন ছুঁই ইয়ুথ ফাউন্ডেশন’

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩  

Find us in facebook

Find us in facebook

‘হামার বাড়ি তিস্তা নদীর চরোত। হুট (হঠাৎ) করি একদিন মোর বেটিটা (মেয়ে) ব্যারামোতে (অসুখ) কাবু হইল। অবস্থা বেগতিক, ডাক্তার সাইব কইলে অক্ত (রক্ত) দেওয়া নাগবে। মুই মূর্খ মানুষ কেংকা করে অক্ত নেওয়া নাগে তাকতো জানো না। মেল্লা (অনেক) মাইনসোক কনু (বললাম), কাও (কেউ) অক্ত দিবার আজি (রাজি) হয় নাই। পরে ফাউন্ডেশনের ছইলগুলাক কনু, ওমরাই মোক অক্তের ব্যবস্থা করি দিলে। সেইদিন অক্ত না পাইলে বেটিটা মোর বাঁচিলে না হয়।’

বিপদের সময় মুমূর্ষু মেয়ের জীবন বাঁচাতে রক্ত সংগ্রহের অভিজ্ঞতার কথা এভাবেই বলছিলেন কৃষক জাইদুল ইসলাম। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই ব্যক্তি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের চর কান্দিনা গ্রামে থাকেন। তিস্তা নদীবেষ্টিত এখানকার বেশিরভাগ মানুষই চরে বসবাস করেন, যাদের জীবন-জীবিকা কৃষিনির্ভর। 

সুবিধাবঞ্চিত চরাঞ্চলের এসব মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্বপ্ন ছুঁই ইয়ুথ ফাউন্ডেশন’। অনগ্রসর চরাঞ্চলের কুসংস্কার দূর, স্কুল শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া রোধে বিনামূল্যে পড়ালেখার ব্যবস্থা, দারিদ্র্য নিরসনে যুবকদের কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি অসহায় মানুষদের চিকিৎসার মতো মৌলিক সেবা ও রক্ত প্রদানের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবী এই সংগঠনটি। 

একঝাঁক তরুণের সমন্বিত প্রয়াসে ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করে স্বপ্ন ছুঁই ইয়ুথ ফাউন্ডেশন। যাদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন। এই সংগঠনটিতে রয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান রাব্বি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শরিফুল ইসলাম ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাজেদুল ইসলামসহ স্বেচ্ছায় মানুষের জন্য কাজ করতে আগ্রহী একঝাঁক নিবেদিত প্রাণ।

প্রতি বছর তিস্তা নদীর ভাঙা-গড়ার খেলার সঙ্গে লড়াই করতে হয় ছাওলা ইউনিয়নবাসীকে। ২৪টি গ্রাম ও মৌজার এই ইউনিয়নে ৪৫ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস। যাদের বেশিরভাগই শিক্ষাবঞ্চিত, কর্মহীন ও অনগ্রসর। এখানকার তরুণ সমাজকে মাদক থেকে দূরে রেখে সমাজের ভালো কাজের সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়াসে স্বপ্ন ছুঁই ইয়ুথ ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য একটি মানবিক সমাজ গঠনে তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। মানুষের পাশে থেকে মানবিক এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা।

জানা গেছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্বপ্ন ছুঁই ইয়ুথ ফাউন্ডেশন স্বেচ্ছায় মানবিক কাজ করে যাচ্ছে। যার ধারাবাহিকতায় রক্তদান, বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়, শীতবস্ত্র বিতরণ, বাল্যবিবাহ ও মাদক নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি, বেকারদের বিভিন্ন কর্মমুখী প্রশিক্ষণ, স্বেচ্ছাসেবীদের ফ্রিলান্সিং প্রশিক্ষণ ও কাজে উদ্বুদ্ধকরণসহ বিভিন্ন রকম কাজ করছে সংগঠনটি। শুধু তাই নয়, চরাঞ্চলের বাচ্চাদের স্কুল থেকে ঝরেপড়া রোধে তরুণরা মিলে গড়ে তুলেছে ‘স্বপ্ন ছুঁই স্কুল’। যেখানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পড়ালেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে অনেক দরিদ্র পরিবারের শিশু-কিশোরদের। 

ছাওলা এলাকার উপকারভোগী ছমেনা বেগম বলেন, ‘মোর ছোট্ট সংসার। স্বামী নাই, দুইটা বেটি আর একটা ব্যাটা। সংসারের হাল ধরার মতো কাও নাই। ওই তকনে খুব কষ্ট করচু। পরে স্বপ্ন ছুঁই ইয়ুথ ফাউন্ডেশনের ছাওয়ারা মোক ছাগল দিছে, সবজির বীজ দিছে, সাথে কিছু গাছের চারা দিছে। নিজে থাকি আয় করা শিখচু বাহে। আল্লাহর রহমতে এ্যালা মুই ভালো আছু।’

সংগঠনটির সভাপতি মেহেদী হাসান অন্যদের অনুপ্রাণিত করতে নিজেই সর্বোচ্চ রক্তদান করেছেন। তিনি দশজনকে রক্ত দিয়েছেন যার মধ্যে ছয়জনই ছিল একেবারেই মুমূর্ষু রোগী। নিজের রক্তে অন্যের জীবন বাঁচানোর অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয় বলে মন্তব্য করেন মেহেদী। তার সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা এ পর্যন্ত সহস্রাধিক মানুষকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে রক্ত প্রদান করছেন বলেও জানান তিনি। 

একবার এক মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচাতে এবি নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন হয়। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক কোথাও থেকে রক্ত সংগ্রহ করতে না পেরে ফোন দেন স্বপ্ন ছুঁই ইয়ুথ ফাউন্ডেশনে। অনেক চেষ্টার পর কাঙ্ক্ষিত রক্ত না পাওয়া গেলে সংগঠনটির এক তরুণ ঢাকা থেকে বিমানযোগে ছুটে আসেন রক্ত দিতে। সেই তরুণের রক্তে মুখে হাসি ফিরেছে আরেক সম্ভাবনাময়ী যুবকের। এবি নেগেটিভ রক্ত সংগ্রহের এ ঘটনাটির শুরু এবং শেষের গল্পটা ছিল খুবই হৃদয়স্পর্শী।  

দেশজুড়ে রক্তদানের এই সেবা ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়ে স্বপ্ন ছুঁই ইয়ুথ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম বলেন, আমরা ভবিষ্যতে স্বপ্ন ছুঁই ব্লাড ব্যাংক নামে একটি অ্যাপস তৈরি করতে চাই, যাতে দেশের সব জায়গা থেকে যেকোনো সময় রক্তের প্রয়োজন হলে মানুষ সহজেই রক্ত সংগ্রহ করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, আমরা শুধু রক্ত দিচ্ছি, তা কিন্তু নয়। উন্নয়ন, কর্মমুখী ও সেবামূলক বিভিন্ন কাজও করছি।  আমরা ১৮ জন যুবককে বিভিন্ন খামারের মাধ্যমে কর্মমুখী করে তুলছি। ৩০ জন নারীকে প্রজেক্ট স্বাবলম্বীর মাধ্যমে দেশি ছাগল দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে গ্রামে উৎপাদিত পণ্য যাতে শহরে বিক্রি করতে পারে সেজন্য চরাঞ্চলের মানুষদের কর্মমুখী করে তুলছি।

সংগঠনটির কোষাধ্যক্ষ মাজেদুল ইসলাম বলেন, আমাদের গ্রাম থেকে উৎপাদিত ঢেঁকিছাঁটা চাল ভালো জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আমরা ঢেঁকিকে মটোরাইজড করে উৎপাদন আগের চেয়ে আরো বেশি করতে সক্ষম হয়েছি। সেই সঙ্গে আমরা গ্রামের পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের কর্মসংস্থান তৈরিতে কাজ করছি। আমরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সার্বিক সহায়তায় প্রায় শতাধিক নারীকে টুপি ও বুটিকসের কাজের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। প্রশিক্ষণ শেষে প্রায় শতাধিক নারীর  আয়ের খাত তৈরি হবে। করোনাকালীন ভালো কাজের জন্য ২০২২ সালে নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্ট আমাদের সংগঠনকেহ সম্মাননা প্রদান করেছে।

স্বপ্ন ছুঁই ইয়ুথ ফাউন্ডেশনের সভাপতি মেহেদী হাসান বলেন, আমাদের অনেক স্বপ্ন। আমরা সবাই মিলে একটা মানবিক ও স্মার্ট সমাজ গঠনে কাজ করে যেতে চাই। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া চরাঞ্চলের মানুষকে এগিয়ে নিতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে চাই। আমরা চরাঞ্চলের মানুষকে পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজির বাগান তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করছি। তাদের মধ্যে বীজ বিতরণ করেছি। আমাদের মাধ্যমে ৩০টি পরিবার পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি বাগানের মধ্য দিয়ে সাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, স্বপ্ন ছুঁই ইয়ুথ ফাউন্ডেশন চরাঞ্চলে শিক্ষা, পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য, চিকিৎসাসেবাসহ মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে। সেই সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের মাধ্যমে তরুণদের ভালো কাজে যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করে আসছে। আর্থিক সমস্যার কারণে কারো যাতে পড়াশোনা বিঘ্নিত না হয়, সে জন্য তরুণদের ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। ইতোমধ্যে অনেকে ফ্রিল্যান্সিংর সঙ্গে যুক্ত হয়ে চাকরি পেয়েছে। আমাদের স্কুল প্রজেক্টে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। আমরা চর জুয়ানে প্রায় পাঁচ শতাধিক ফলজ, বনজ ও ওষুধি গাছ রোপণ করেছি। 

চরের মানুষের স্বপ্ন ছুঁয়েছে তরুণদের গড়া এই সংগঠনটি। তাদের কর্মকাণ্ডে খুশী স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও। চরাঞ্চলের মানুষের আস্থা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে শহরের মানুষের মনেও জায়গা করে নিয়েছে সংগঠনটির একঝাঁক উদ্যোমী তরুণ। 

স্বেচ্ছাসেবী এই সংগঠনের প্রশংসা করে ছাওলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজির হোসেন বলেন, করোনাকালে সংগঠনটির কার্যক্রম সবার নজরে আসে। যারা কাজ করছে, সবাই তরুণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। তাদের ভালো কাজ দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হচ্ছে। এটা আমাদের সবার জন্য ভালো। 

Place your advertisement here
Place your advertisement here