• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook
সর্বশেষ:
ছয়দিনের সফরে ব্যাংককে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী গরমে ‘অতি উচ্চ ঝুঁকিতে’ বাংলাদেশের শিশুরা: ইউনিসেফ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা: বেরোবি কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী ৩১ হাজার ৯৪৬ জন বাংলাদেশ-ভারত ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে: ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী কাতারের আমিরের সফরে যা পেল বাংলাদেশ

৯ বছরে বিয়ে হওয়া সেই আছিরন আজ গ্রামের গর্ব

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৮ মার্চ ২০২৩  

Find us in facebook

Find us in facebook

বাড়ির আঙিনায় গ্রামের নারীদের সঙ্গে নিয়ে হস্তশিল্পের কাজ করছেন আছিরন নেছা। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে পাটজাত পণ্য তৈরি করে চলেছেন এই নারী উদ্যোক্তা। ঝুড়ি, পাপোশ, ম্যাট, ব্যাগ, দোলনা, পুতুল, কলমদানি, খেলনা হরিণসহ অন্যান্য সব জিনিস তৈরি হচ্ছে তার শৈল্পিক হাতের স্পর্শে। আর এইসব পণ্য যাচ্ছে জাপান, জার্মানি, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে।

অথচ এই আছিরন নেছার জীবনের গল্পটা ছিল একেবারে ভিন্ন। নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান পায়রাবন্দের জয়রামপুর গ্রামে থাকেন আছিরন। সেই স্থানে জন্মেও বাল্যবিবাহ থেকে মুক্তি মেলেনি আছিরন নেছার।  

যখন প্রাথমিকের গণ্ডি পার হবার কথা নয়, ঠিক তখনই বিয়ের পিড়িতে বসেছিলেন আছিরন। মাত্র ৯ বছর বয়সে বাল্যবিবাহ হয়েছিল তার। বইখাতা ছেড়ে স্বামীর সংসারের হাল ধরেন তিনি। বছর দুয়েক ঘুরতে না ঘুরতেই কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে কন্যাসন্তান। কিন্তু অভাবের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে সেই ফুটফুটে কন্যাকে সাত বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন তিনি। তখন আছিরনের বয়স ১৮।

সেই সময়ই লজ্জা আর চোখের পানি নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন আছিরন। সেই স্বপ্ন আজ বাস্তব। বাল্যবিবাহ ও সংসারের অভাব দমাতে পারেনি অদম্য আছিরন নেছাকে। আছিরন শুধু নিজের দিন বদল করেননি। পায়রাবন্দের জয়রামপুর, খোর্দ মুরাদপুর, তকেয়া, কেশবপুর, জোতষষ্ঠি ও ইসলামপুর গ্রামে ঘুরে ঘুরে নারীদের বিনামূল্যে হস্তশিল্পের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। পাট দিয়ে হস্তশিল্পের কাজ করে নিজের ভাগ্য বদলের পাশাপাশি স্বাবলম্বী করেছেন গ্রামের দেড় শতাধিক নারীকে। তাদের অনেকেই নিজেদের অবস্থান থেকে হস্তশিল্পের সঙ্গে কাজ করছেন। আবার অনেকে চাকরিও করছেন। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠান ‘অনেক আশা কুটির শিল্প’ থেকে তৈরি নানা পণ্য দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে যাচ্ছে বিদেশেও। 

গ্রামের নারীরা বলছেন, গ্রামে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন আছিরন। সে আমাদের গর্ব। সংসারের অভাব অনটন দূর করে তিনি শুধু নিজের দিনবদল করেননি, গ্রামের অন্যান্য নারীদেরও স্বাবলম্বী করে তুলেছেন। তবে তার শুরুর পথটা মসৃণ ছিল না।

জয়রামপুর গ্রামে আছিরন নেছার জীবনগল্প জানতে গিয়ে কথা হয় কয়েকজন নারীর সঙ্গে। আছিরন নেছার হাত ধরে হস্তশিল্পের কাজ শিখেছেন রমেজা বেগম। এক সময় স্বামীহারা সংসারের ধকল গেছে তার ওপর দিয়ে। এখন আট বছর ধরে আছিরনের সঙ্গে পাট দিয়ে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী তৈরি করছেন তিনি।

পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী এই নারী জানান, সাত বছর আগে তার স্বামী মারা গেছেন। এরই মধ্যে দুই ছেলেমেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন তিনি। আছিরন নেছার কাছ থেকে তিনি অনেক কাজ শিখেছেন। এরজন্য কোনো টাকা লাগেনি। আছিরনের সঙ্গে কাজ করে তিনি যে টাকা পাচ্ছেন, তা দিয়ে ভালোভাবেই তার সংসার চলছে।

একই গ্রামের কোহিনুর বেগম। তিনি প্রায় এক দশক ধরে আছিরনের সঙ্গে কাজ করছেন। উপার্জিত টাকা দিয়ে তিন সন্তানের লেখাপড়ার খরচ যোগান দিচ্ছেন। এখন তার সংসারে অভাব নেই। আগের মতো দুবেলা দুমুঠো ভাতের জন্য এখন কষ্ট করতে হয় না। আছিরনের সঙ্গে কাজ করে নিজে উপার্জন করার পাশাপাশি তিনি তার স্বামীকে একটা অটোরিকশাও কিনে দিয়েছেন।

এদিকে আছিরন নেছার পরিবারের সদস্যরা বলছেন, এক সময় ঠিকভাবে তারা দুবেলা দুমুঠো ভাত খেতে পারতেন না। এখন থাকা খাওয়ার অভাব দূর হওয়ার পাশাপাশি বসতভিটায় পাকা একটি শোরুম আছে। বাড়ির সামনে আছিরন তার স্বামী খলিলুর রহমানকে একটি মুদিদোকানও করে দিয়েছেন।

আছিরন নেছা জানান, ১৯৯২ সালে স্থানীয় এক দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সুদে চার হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। সেই ঋণের টাকার সুদ বাড়তে বাড়তে এক সময় তা গিয়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার। টাকা পরিশোধ করতে না পেরে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে যান আছিরন কিন্তু সেখানেও চাকরি জোটেনি। শেষমেশ তার শাশুড়ি জমি বন্ধক রেখে সেই দাদন ব্যবসায়ীকে ঋণের টাকা পরিশোধ করে দেন। এরপর বাড়ি ফিরে আসেন আছিরন নেছা।

১৯৯৪ সালে শাশুড়ির দেওয়া সেলাই মেশিন দিয়ে টুকটাক কাজ শুরু করেন। পরে নিজে ও দুই মেয়েকে নিয়ে পাট দিয়ে হস্তশিল্পের পণ্য তৈরি করতে লাগলেন। কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়া আছিরন হস্তজাত পণ্য বুননের কাজে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তার কাজে প্রথম সহায়তা করেন তার দুই মেয়ে কোহিনুর বেগম ও গোলেনুর বেগম। হস্তজাত পণ্য তৈরি দেখে গ্রামের অন্য নারীরাও এগিয়ে আসেন। তখন বিনামূল্যে নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটিও শুরু করেন আছিরন।

আছিরন নেছা বলেন, ২০০৭ সালে হস্তশিল্প নিয়ে বগুড়ার নুনগোলার একটি বড় মেলায় অংশ নিয়েছিলাম। সেই মেলা থেকে কিছু লাভ হয়। সেই লাভের টাকায় ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে। পরে ‘অনেক আশা কুটির শিল্প’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। এই প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মীর সংখ্যা প্রায় পঞ্চশের কাছাকাছি। পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকায় এখন উৎপাদনও বেড়েছে। রংপুর ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুরসহ বেশকিছু এলাকায়ে মেলার মাধ্যমে আমার প্রতিষ্ঠানের তৈরি পণ্য ছড়িয়ে পড়েছে।

ব্যবসার পুঁজি কম হওয়ায় এখনও একসঙ্গে বেশি কাজ করতে না পারছেন আছিরন নেছা। সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতা পেলে বেকার নারীদের সঙ্গে নিয়ে আরও বড় পরিসরে এই কাজ শুরু করা সম্ভব বলে জানান এই উদ্যোক্তা।

এদিকে আছিরন নেছা সম্পর্কে পায়রাবন্দের রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগারের উদ্যোক্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, এই গ্রামের নারীদের স্বাবলম্বী করতে আছিরনের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, লড়তে হয় তা তিনি নারীদের শিখিয়ে চলেছেন। আছিরন অনেক নারীর জীবনে দিনবদলের অনুপ্রেরণা।
 
পায়রাবন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবার রহমান বলেন, মেয়েদের অবহেলা করা ঠিক নয়। আজ আমাদের আছিরন গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছে। তার হাত ধরে অনেকেই আজ কর্মমুখী। এভাবে তার মতো অন্য নারীরাও এগিয়ে এলে প্রতিটি গ্রামে আছিরনের মতো দৃষ্টান্ত তৈরি হবে।  

Place your advertisement here
Place your advertisement here