• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook

১৫ আগস্ট, আমাদের শোক

দৈনিক রংপুর

প্রকাশিত: ১১ ডিসেম্বর ২০১৮  

Find us in facebook

Find us in facebook

জগতে মানুষজন প্রাকৃতিক নিয়মেই এতিম হয়। তবে একইদিনে, একই সময়ে এতিম হবার ঘটনা এ বিশ্বে বিরল । তবে অসম্ভব নয়। সম্ভব যে,তার প্রমাণ ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট। বর্তমান প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনা এবং তাঁর সহোদরা শেখ রেহানা একদিনেই পিতৃমাতৃহীন হয়েছেন। শুধু তাই নয় হারিয়েছেন পুরো পরিবারের সব সদস্যসহ অনেক পরিজন। কনিষ্ঠ ভ্রাতা শিশু রাসেলও ঘাতকদের বুলেট থেকে রেহাই পায়নি। 

শত্রুর শেষ রাখতে নেই, এমন পণ নিয়েই বুঝি তারা হত্যায় মেতেছিল। শুধু শেখ মুজিব নয়, মুজিবের রক্তবিন্দুও হত্যাকারীদের জন্য ছিল ভয়ানক আতঙ্কেও নামান্তর। নিয়তির বিধানে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা রয়ে গেলেন জীবিত। এই শোক বলার নয়, প্রচার বা প্রকাশেরও নয়। এ শুধু অনুভব করার। যার গেছে, সেইই বোঝে। বোঝেন শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা। আমরা শুধু বলতে পারি, পক্ষে বিপক্ষে নানা রকম বাহাস করতে পারি। তাতে ব্যক্তিশোকের কোনও ব্যত্যয় হয় না, কমবেশিও।

তবে এ শুধু ব্যক্তি শোক নয়, জাতীয় শোকও। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শহীদ হলেন নিষ্ঠুরতম হত্যাকান্ডের দ্বারা। যার কোনও দৈশিক কারণ ছিল না। একমাত্র বৈশ্বিক ষড়যন্ত্রই এই অভাবিত নারকীয় হত্যার মূল। এক সামরিক সামরিক সদস্যের পারিবারিক পর্যায়ে বিতন্ডা, খাদ্যাভাব কিংবা বাকশাল গঠন- সবই ঠুনকো অজুহাত, আসল সত্যকে চাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে। বিভিন্ন দেশী-বিদেশী দালিলিক সাক্ষ্য উদঘাটিত হয়েছে, আরও হবে।

আমাদের দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক হিসেবে যাকে পেলাম, তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন বিতর্কিত এক ব্যক্তি এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচরদের একজন। মন্ত্রিসভার সদস্যরাও বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগেরই। জাতি দিশাহীন এক বিভ্রান্তির ঘোরে থাকল। আমাদের আরও দুর্ভাগ্য আমরা মুখে যত বলি, লিখি তার চেয়ে একদম কম। আমাদের রাজনীতিবিদ, সরকারি আমলা তারা কেউ স্মৃতিচারণ করে কিছু লেখেন না।

তারা লিখলে আমরা সাধারণ মানুষ কিছু কৌতূহল মেটাতে পারতাম। কেননা তারা সর্বদাই ঘটনার কেন্দ্রের পারপাশের কক্ষপথ জুড়ে থাকেন। কাছে দেখার জাতির ইতিহাস সঠিকভাবে নির্মাণের জন্য ঐসব উপাদান ভবিষ্যতে ইতিহাসকারের কাজে আসতো। সম্ভব হতো নানা কথার আড়ালে লুকায়িত সত্য খুঁজে বের করা।

নভেম্বরে জেলখানায় হত্যা করা হলো জাতীয় চার নেতাকে। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। জাতির প্রতি, বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁদের আনুগত্য ছিল প্রমাণিত । তাদের নেতৃত্ব ছিল দেশের জন্য পরীক্ষিত। আগস্টে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নির্মূল করা এবং নভেম্বরে জেলখানায় চার নেতাকে হত্যা করা একই সূত্রে গাঁথা। 

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যাতে কোন উপযুক্ত নেতা না থাকে। দেশ পরিচালনায় যাতে কারো গ্রহণযোগ্যতা অধিকতর বিবেচনায় ঘাতক ষড়যন্ত্রীদের পথে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়। মোশতাক এবং তার সহযোগী হত্যাকারীরা দেশকে যথাযোগ্য নেতৃত্ব শূন্য রেখে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল।

১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের পর দেশবাসী প্রকৃত অর্থেই দিশা হারিয়ে ফেলে। আমরা ব্যাপক কোন প্রতিবাদী কন্ঠ পাই না। তৎকালীন আওয়ামী লীগের কোনও নেতাকে রাস্তায় পাই না। যিনি জনতাকে সঙ্গে নিয়ে সারা দেশে এই নারকীয় হত্যার প্রতিবাদ জানাবেন। একটি আধা সামরিক বাহিনী ছিল, রক্ষীবাহিনী; এই বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের শেষ প্রত্যাশা ছিল, তারা দেশের এই দুর্যোগে সহায়ক শক্তি হিসেবে সক্রিয় হবে।

রক্ষীবাহিনী নিয়ে হত্যাকারীরাও আতঙ্কেই ছিল। কোনও অজ্ঞাত কারণে তারা নিষ্ক্রিয় থাকল। কিন্তু দেশবাসী দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া রাজনৈতিক নেতাকমীদের উল্লেখযোগ্য কোনও প্রতিবাদ চাক্ষুষ করল না। বাঘা সিদ্দিকী দেশান্তরী হলেন। তার নেতৃত্বে মুৃজিব হত্যার প্রতিশোধ যুদ্ধে অনেকেই বীরের মত প্রাণ দিলেন। প্রাণ দিলেন বেশ কিছু রাজনৈতিক কর্মী, যারা বিবেকের মহান তাড়নায় এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসায় শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলেন। তাদের অনেকেই দীর্ঘকাল কারাভোগ করে আজও বেঁচে আছেন। আমরা কজন তাঁদের খবর রাখি!

৭৫ এর ১৫ আগস্ট দেশবাসী দেখল কোথাও কেউ নেই। কিছু মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানের অনুসারী হয়ে গেল। জয়বাংলা হয়ে গেল বাংলাদেশ জিন্দাবাদ আর বাংলঅদেশ বেতার হলো রেডিও বাংলাদেশ । বাংলাদেশে পাকিস্তানী ধ্যানধারণা প্রচারিত ও প্রসারিত হতে থাকল। অবস্থা এমন দাঁড়াল, মনে হল, এ দেশের নাম বুঝি একদিন বাকিস্তান, বা এই রকমের কিছু বলে পরিচিত হবে। এরপরের ইতিহাস সবারই জানা। 

সেই হত্যার প্রতিবাদ ও প্রতিশোধ নিতে না পারার দায় জাতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছে। বিশ্ব এখনো বাংলাদেশকে যতটুকু চেনে তার চেয়ে অনেক বেশি চেনে ,জানে শেখ মুজিবকে, মুজিবের দেশকে । একজন রাষ্ট্রনায়ক তাই যথার্থই বলেন তিনি হিমালয় দেখেননি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছেন।

মুজিব হত্যার পর সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কেউ ব্যাপক গবেষণা করেছেন কিনা জানা যায় না। সম্প্রতি টিভি চ্যানেলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৫ আগস্ট থেকে কেউ সারা অঙ্গে কালো পোশাক পরিধান করছেন, কেউ মাটিতে শয়ন করছেন। তারা ব্যক্তিগত প্রতিবাদে এভাবেই জাতির পিতার হত্যার শোক বহন করছেন, আমৃত্যু করবেন। 

শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এতিম, তাদের ঘরবাড়ি নেই বলে প্রত্যন্ত গ্রামের এক প্রান্তিক আয়ের মানুষ সঞ্চিত অর্থ দিয়ে শেখ হাসিনাকে এক খন্ড জমি কিনে সাফ কবালা দলিল করে দিয়েছেন। এ হলো স্বল্প কথায় মুজিবের প্রতি সামান্য মানুষের অকৃত্রিম, অসামান্য ভালবাসা। এই মুজিবের মৃত্যু নেই, এই মুজিব অমর, অজড়, অক্ষয়। কোনও ঘাতকের শক্তি নেই এই মুজিবকে হত্যা করে। সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কন্ঠে ‘জয় মুজিবের জয়’ চিরকাল ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে।

Place your advertisement here
Place your advertisement here