• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook
সর্বশেষ:
ছয়দিনের সফরে ব্যাংককে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী গরমে ‘অতি উচ্চ ঝুঁকিতে’ বাংলাদেশের শিশুরা: ইউনিসেফ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা: বেরোবি কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী ৩১ হাজার ৯৪৬ জন বাংলাদেশ-ভারত ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে: ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী কাতারের আমিরের সফরে যা পেল বাংলাদেশ

শেখ হাসিনা: সাহস ও দৃঢ়তার নাম

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৮ মে ২০২১  

Find us in facebook

Find us in facebook

বিভুরঞ্জন সরকার

শেখ হাসিনা যদি সাহস এবং দৃঢ় মনোভাবের পরিচয় দিয়ে দেশে না ফিরতেন তাহলে একদিকে মানুষ তার নেতৃত্বগুণের সমালোচনা করত, অপরদিকে জরুরি সরকারও তাদের অন্যায্য কাজ চালিয়ে যাওয়ার উৎসাহ পেত। শেখ হাসিনাকে ভয় দেখানোর ক্ষমতা তাদের আছে– এটা বুঝলে তাদের আস্থা বাড়ত। ভয় দেখিয়ে শেখ হাসিনাকে যে কাবু করা যাবে না– এই বুঝ ৭ মে হয়েছিল জরুরি সরকারের নীতিনির্ধারকদের।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালের রাজনৈতিক ইতিহাসে ৭ মে তারিখটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে। অনেকেই হয়ত ভাবতে পারেন ৭ মে এমন কী ঘটেছিল, যার জন্য তারিখটি লাল অক্ষরে লেখার মতো? ২০০৭ সালের ৭ মে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা চিকিৎসা শেষে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন। তিনি উন্নত চিকিৎসা নিতে লন্ডন গিয়েছিলেন, চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসবেন– এটাই তো স্বাভাবিক। এতে বিশেষ তাৎপর্য কী আছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের ২০০৬-০৭ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট একটু বিবেচনায় নিতে হবে।

২০০৬ সালে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ছিল। কিন্তু তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের নানা অপতৎপরতায় সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে সংশয় দেখা দেয়। যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছা থেকে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার নানা অপকৌশলের দিকে হাঁটতে থাকে বিএনপি এবং তার মিত্র জামায়াতসহ অন্যরা। তবে সবকিছুর স্টিয়ারিং ছিল বিএনপির হাতে। অনুগত নির্বাচন কমিশন গঠন, ভুয়া ভোটার তালিকা তৈরি এবং পছন্দের ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার জন্য বিচারপতিদের চাকরির বয়সসীমা বাড়িয়ে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী গণতান্ত্রিক মহলে সন্দেহ তৈরি করে প্রকৃতপক্ষে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তোলা হয়। বিএনপি-জামায়াতের অভিসন্ধির বিরুদ্ধে শুরু হয় প্রতিবাদ-আন্দোলন। ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন বিএনপি কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে তাদের বদমতলব বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে থাকে।

তারা এক সময়ের বিএনপি নেতা এবং তখন প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে চাইলে আওয়ামী লীগসহ অন্য দলগুলো আপত্তি জানায়।

কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন শুরু করে। দেশে একটি অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার পরিবেশ তৈরি হয়। জনমত উপেক্ষা করে বিএনপি তাদের লক্ষ্য পূরণে অগ্রসর হতে থাকে।
তাদের দুষ্টবুদ্ধির পৃষ্ঠপোষক হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। প্রবল আন্দোলনের মুখে মাহমুদ হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের দায়িত্ব নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করলে সবাইকে অবাক করে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন বিএনপির মদদে নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ঘোষণা দেন। বিএনপির এসব একতরফা কর্মকাণ্ড দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলে।

২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে মাঠের আন্দোলনের ওপর জোর দেয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার শক্তি প্রয়োগের নীতি নিয়ে দেশকে এক চরম সংকটের মুখে ঠেলে দেয়। রাজপথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ঘ শুরু হয়।

এই অবস্থায় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের নেতৃত্বে কজন সেনাকর্মকর্তা বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে চাপ দিয়ে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে বাধ্য করেন। নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে ড. ফখরুদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। দেশে এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়।

ক্ষমতার মঞ্চ থেকে খালেদা জিয়ার বিএনপি অপসারিত হওয়ায় সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি তৈরি হয়। সেনাবাহিনী সমর্থিত ফখরুদ্দীনের সরকার দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবে ধরে নিয়ে শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ এই প্রক্রিয়ার পক্ষেই অবস্থান নেয়।

এরমধ্যেই কানসহ অন্য স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান শেখ হাসিনা। কিন্তু ধীরে ধীরে জরুরি সরকার এমন সব পদক্ষেপ নিতে শুরু করে, যা দেশে নতুন সন্দেহ ও বিতর্ক সৃষ্টি করে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলে প্রাথমিকভাবে অনেকে সমর্থন করলেও কিছুদিনের মধ্যে এটা মনে হতে থাকে যে, ওই সরকারও বাড়াবাড়ি করতে শুরু করেছে।

রাজনীতিকদের ‘শিক্ষা’ দেয়ার একটি মনোভাব ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিন গংয়ের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখা যায়। তারা শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার লক্ষ্য নিয়ে এগোতে থাকে। সুশীল সমাজের একাংশ এবং দুএকজন সম্পাদক এ কাজে তাদের উৎসাহ জুগিয়ে সরাসরি অবস্থান নেন। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির ভেতর থেকেও দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার মতো কিছু নেতা পেতে জরুরি সরকারের অসুবিধা হয়নি।

নিজেদের নিয়ন্ত্রণ শক্ত করার নানামুখী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শেখ হাসিনার দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ষড়যন্ত্রের বিষয়টি আঁচ করতে শেখ হাসিনার অসুবিধা হয়নি। দেশের মানুষকে সংগঠিত করে দ্রুত একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আদায়ের গুরুত্ব বুঝেই শেখ হাসিনা সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ২০০৭ সালের ৭ মে দেশে ফিরে আসেন। বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়ে বিপুলসংখ্যক জনতা শেখ হাসিনার প্রতি তাদের সমর্থনের কথা জানান দেন।

শেখ হাসিনা যদি সাহস এবং দৃঢ় মনোভাবের পরিচয় দিয়ে দেশে না ফিরতেন তাহলে একদিকে মানুষ তার নেতৃত্বগুণের সমালোচনা করত, অপরদিকে জরুরি সরকারও তাদের অন্যায্য কাজ চালিয়ে যাওয়ার উৎসাহ পেত। শেখ হাসিনাকে ভয় দেখানোর ক্ষমতা তাদের আছে– এটা বুঝলে তাদের আস্থা বাড়ত। ভয় দেখিয়ে শেখ হাসিনাকে যে কাবু করা যাবে না– এই বুঝ ৭ মে হয়েছিল জরুরি সরকারের নীতিনির্ধারকদের।

শেখ হাসিনা দেশে ফিরে দলের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে জনমত গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিনের মাথায় হয়ত অন্য মতলব ছিল। তারা আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে তাদের অনুকূলে একটি রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে চেষ্টা করছিল।

ড. ইউনূস, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর মতো কিছু মানুষকে তারা পেয়েওছিল। কিন্তু শেখ হাসিনাকে মুক্ত রেখে, আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ বা অটুট রেখে তাদের পরিকল্পনা সফল করা যে সম্ভব নয়, সেটা বুঝেই ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আওয়ামী লীগ ভাঙার অপচেষ্টাও চলে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্যের সততা নিয়ে মানুষের মনে ততদিনে সন্দেহ তৈরি হয়ে গেছে। তুচ্ছ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলযোগ পাকাতে গিয়ে সেনাসদস্যদের বাড়াবাড়ির প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে ওঠার ঘটনাটিও উল্লেখযোগ্য।

শেখ হাসিনাকে ১১ মাস আটক রেখে ২০০৮ সালের ১১ জুন মুক্তি দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসার জন্য তিনি আবার বাইরে যান এবং ৮ নভেম্বর দেশে ফিরে নির্বাচনি প্রচারে নেমে পড়েন।

২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় অর্জন করে। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি ২০০৬ সালে ক্ষমতায় থাকার জেদে যেসব অপকৌশল অবলম্বন করেছিল তা দলটির জন্য বুমেরাং হয়েছে। ভুল থেকে শিক্ষা না নিয়ে পরবর্তী সময়েও ভুল রাজনৈতিক কর্মসূচি, কৌশল এবং সহিংসতার পথ ধরে বিএনপি যে বড় খাদে পড়েছে তা থেকে আর উঠতে পারছে না।

আপসহীন, দৃঢ় মনোভাব এবং নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে মানুষের সঙ্গে থাকলে তার ফল খারাপ হয় না। কঠোরতা এবং নমনীয়তা– দুটোই রাজনীতির কৌশল। কখন কোনটা ব্যবহার করা হবে, সেটা নির্ভর করে ব্যক্তির বিচক্ষণতার ওপর। শেখ হাসিনা রাজনীতিতে কোন ধারার অনুসারী তা এতদিনে সবার কাছে স্পষ্ট হওয়ারই কথা। তার সাহস আছে, দৃঢ়তা আছে আর আছে মানুষের প্রতি গভীর দরদ।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রাজনীতির সাধারণ নিয়মনীতি অনুসরণ না করে বার বার জটিলতা ও সংকট তৈরি করে কিন্তু শেখ হাসিনা ধৈর্যের সঙ্গে ঠাণ্ডা মাথায় তা মোকাবিলা করেন। তাই তিনি সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সরকারপ্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে রেকর্ড তৈরি করেছেন। কেউ ইতিহাস দখল করতে চায়, কেউ চায় সৃষ্টি করতে। শেখ হাসিনার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন ইতিহাসের স্রষ্টা, তেমনি শেখ হাসিনাও জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিহাস তৈরি করেছেন, করছেন।

Place your advertisement here
Place your advertisement here