• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook

বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় মুসলিম নাবিকের মানচিত্র

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৫ জানুয়ারি ২০২১  

Find us in facebook

Find us in facebook

উসমানি খেলাফত পতনের পর তুরস্কের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে তোপাকাপি জাদুঘরের গ্রন্থাগারে জার্মান প্রাচ্যবিদ গুস্তাভ অ্যাডলফ ডেইসম্যান (Gustav Adolf Deissmann) কর্মরত ছিলেন। ১৯২৯ সালের ৯ অক্টোবর গ্রন্থাগারের পুরনো বিষয় বিন্যাসকালে হরিণের চামড়ায় আঁকা মানচিত্রের ওপর তাঁর চোখ পড়ে। ষষ্ঠদশ শতাব্দীর প্রাচীন মানচিত্রে আমেরিকার অবস্থান দেখে তিনি বেশ অবাক হন। পিরি রেইস নাবিকের আঁকা মানচিত্রে ৯১৮ হিজরি (১৫১৩ খ্রি.) লেখা ছিল। আধুনিককালে পাওয়া প্রাচীন মানচিত্রগুলোর মধ্যে শুধু পিরি রেইসের মানচিত্রে আমেরিকার অবস্থান পাওয়া যায়। ক্রিস্টফার কলম্বাসের হারানো মানচিত্রের ধারণা পাওয়া যায় পিরি রেইসের মানচিত্রে।

পিরি রেইসের পরিচিতি : আহমদ মহিউদ্দিন পিরি রেইস আনুমানিক ১৪৬৫ সালে ইস্তাম্বুল নগরীর পশ্চিমাঞ্চল গ্যালিপোলিতে জন্মগ্রহণ করেন। মারমারা সাগরের উপকূলবর্তী এই শহরটি অটোমান সাম্রাজ্যের প্রধান নৌ ঘাঁটি ছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের শায়খুল ইসলাম আহমদ বিন কামাল পাশা বলেন, ‘গ্যাপোলির অধিবাসীরা কুমিরের মতো নিজেদের পুরো জীবন সমুদ্রে অতিবাহিত করে। নৌ তরীগুলো যেন তাদের পরিবার। সাগর ও জাহাজের মধ্যে তারা দিন-রাত অতিবাহিত করে।’

আঞ্চলিক ঐতিহ্য অনুসারে পিরি রেইস পড়াশোনা শেষ করে চাচার সঙ্গে নৌযাত্রা শুরু করেন। রেইসের চাচা কামাল রেইস অটোমান নৌবাহিনীর নাবিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। চাচার সঙ্গে ভূমধ্যসাগরে অটোমান নৌবাহিনীর সদস্য হয়ে অনেক দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এরপর সুলতানের আমন্ত্রণে নাবিক হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে নৌবাহিনীতে যোগ দেন। ১৫১০ সালে কামাল রেইস ভূমধ্য সাগরে মিসর যাত্রাকালে জাহাজ ডুবে মারা যান।

এরপর মহিউদ্দিন পিরি রেইস অটোমান সুয়েজ নৌবহরের প্রধান নাবিক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। চাচার মৃত্যুর পর পিরি রেইস অবসর নিয়ে নিজ এলাকা গ্যালিপোলিতে আসেন। ১৫১৩ সালে এখানেই প্রথমবার পৃথিবীর মানচিত্র অঙ্কন করেন। ১৫১৭ সালে পিরি মানচিত্রটি অটোমান সুলতান প্রথম সেলিমের কাছে পেশ করেন। মানচিত্র তৈরিতে পিরি রেইস ২০টি আঞ্চলিক মানচিত্রের ওপর নির্ভর করেছেন। আরবদের তৈরি ভারতবর্ষের মানচিত্র, পর্তুগিজদের তৈরি ভারত-চীনের চারটি মানচিত্র, কলম্বাসের তৈরি উপকূল ও দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে পশ্চিমাঞ্চলের মানচিত্রের সমন্বয়ে প্রথম মানচিত্রটি তিনি তৈরি করেন।

সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ রচনা : নাবিকজীবনে ভ্রমণ করা বিভিন্ন জায়গার তথ্য, চার্ট, নকশা করা মানচিত্র সংগ্রহ করেন। বিভিন্ন স্থানের ভৌগোলিক বর্ণনা ও সমুদ্রবিষয়ক অনেক তথ্য নিয়ে ১৫১৩ সালে তিনি ‘কিতাব ই বাহরিয়া’ গ্রন্থ রচনা করেন। ১৫২৬ সালে গ্রন্থটি পুনঃসম্পাদনা করে তা সুলতান সোলায়মানের কাছে পেশ করেন। ১৫২৮ সালে দ্বিতীয়বার মানচিত্র অঙ্কন করে সুলতানের কাছে উপস্থাপন করেন। দ্বিতীয় মানচিত্রের এক-ষষ্ঠাংশ পাওয়া গেছে। পিরি রেইসের আঁকা দ্বিতীয় সমৃদ্ধ মানচিত্র দেখে গবেষকরা বিস্ময় প্রকাশ করেন। তবে মানচিত্রের অনেক অংশ অনাবিষ্কৃত হওয়ায় গবেষকরা দুঃখ প্রকাশ করেন।

বিশ্বের সব ইতিহাসবিদের কাছে সর্বশেষ আবিষ্কৃত পিরি রেইসের মানচিত্র খুবই গুরুত্ব বহন করে। কারণ আধুনিককালে পাওয়া প্রাচীন মানচিত্রগুলোর মধ্যে শুধু পিরি রেইসের মানচিত্রে আমেরিকার অবস্থান পাওয়া যায়। আর ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মানচিত্রটি হারিয়ে যায়, যা আর কোথাও পাওয়া যায়নি। আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলের মানচিত্র আঁকার ক্ষেত্রে পিরি রেইস কলম্বাসের মানচিত্রের সহায়তা নেন বলে ধারণা করা হয়।

পিরি রেইসের মানচিত্রের ৫০০ বছর পূর্তি : পিরি রেইসের আঁকা মানচিত্রটি নথি ও মানচিত্রবিষয়ক বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১৩ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো পিরি রেইসের আঁকা মানচিত্রের ৫০০ বছর পূর্তি উদযাপন করে। ইস্তাম্বুলের মিমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত তোফ্যান আমিরি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ‘পিরি রেইস ও বিশ্ব মানচিত্র ১৫১৩ : ৫০০ বছরের অস্পষ্টতা’ নামে একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।

মৃত্যু : ১৫৫৪ সালে ৯০ বছর বয়সে পিরি রেইস লোহিত সাগর ও আরব সাগরে জাহাজের নাবিক ছিলেন। এ সময় পর্তুগিজদের সঙ্গে এক যুদ্ধে পরাজিত হলে রেইসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে অটোমান আদালতে অভিযোগ করা হয়। যুদ্ধ থেকে রেইস মিসর এলে স্থানীয় লোকেরা সুলতানের কাছে অভিযোগ করে যে রেইস নিজের প্রাণ ও সম্পদ বাঁচাতে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেছে। মূলত তিনি নিজে ও তাঁর চাচা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ থেকে তা পেয়েছিলেন। অবশেষে সুলতান তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন এবং সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তোপাকাপি জাদুঘরে রেখে দেন।

তুর্কি লিরায় মানচিত্রের ছাপ : পিরি রেইসের মানচিত্রটি বর্তমানে তোপাকাপি জাদুঘরে আছে। সাধারণত দর্শকদের জন্য প্রদর্শনীতে তা রাখা হয় না। তবে বিভিন্ন সময় তুরস্কের মুদ্রায় মানচিত্রটির ছবি ছাপা হয়েছিল। ১৯৯৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মানচিত্রের প্রতিকৃতি ছাপা হয়।

Place your advertisement here
Place your advertisement here