• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook

পরিচর্যায় আশুড়ার বিল হবে বিশ্বের অন্যতম তীর্থকেন্দ্র

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৮ জুন ২০২০  

Find us in facebook

Find us in facebook

একপাশে ঘন সবুজ শালবন। আরেক পাশে মাঝে মাঝে রয়েছে দ্বীপের মতো । সেখানেও ঘন সবুজ শালবন। মাঝে একটি বিল। ঘন সবুজ বন আর বিলের মাঝে প্রতিদিন সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তে এক অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা। মনে হয় প্রকৃতি তার হৃদয়ের জমানো নৈসর্গিক সব সৌন্দর্য  ঢেলে দিয়েছে এখানে। বিলটির নাম আশুড়ার বিল। ঘন শালবনটি শেখ রাসেল জাতীয় উদ্যান। 

নবাবগঞ্জ ও বিরামপুর মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নবাবগঞ্জ অংশের ২৫১ হেক্টর এবং বিরামপুর অংশের ১০৯ হেক্টর নিয়ে মোট ৩৬০ হেক্টর এলাকাজুড়ে এই আশুরা বিল।  ৫১৭.৬১হেক্টর সংরক্ষিত বনাঞ্চল নিয়ে শেখ রাসেল জাতীয় উদ্যান। ২০০৮ সালে এটি জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। এই বিল ও বনকে ঘিরে বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি তৈরির ঘোষণা দিয়েছেন নবাবগঞ্জের ইউএনও মোছা.নাজমুন নাহার। 

স্থানীয়রা জানান, একসময়ের লাল-সাদা শাপলায় ভরপুর দৃষ্টিনন্দন ছিল বিলটি। আসতো শীতের অতিথি পাখি। বিলটি আগে ছিল নদী। যে নদীকে ঘিরে এ অঞ্চলে বসতি গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন বৌদ্ধ ও  ধর্মীয় স্থাপনাকে কেন্দ্র করে। বন ঘেঁষে উত্তর পশ্চিমে রয়েছে ঐতিহাসিক সীতার কোর্ট বিহার। পাশেই রয়েছে ঐতিহাসিক অনন্য পুরাকীর্তি সীতাকোর্ট বিহার। এ বিহারকে ঘিরে রামায়ণের সীতার বনবাস নিয়ে রয়েছে পুরোনো কাহিনি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক স্বাধীন সেন জানান, আশুড়ার বিল ঐতিহাসিকভাবেই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ বিরামপুর-নবাবগঞ্জ-ফুলবাড়ী এলাকায় গবেষণা করতে গিয়ে এই বিলকে ওই অঞ্চলের মানববসতির ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতোভাবে জড়িত একটি আদি নদী খাতের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই আশুড়ার বিল ও বর্তমান নলশীশা নদী মিলে একটি নদী আদি মধ্যযুগে ছিল। স্থানীয়রা, এখনো আশুর নদীর কথা বলে থাকেন। ফ্রান্সিস বুকাননও এইখানকার একটি পরিত্যক্ত নদীখাতকে আশুর নদী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন ঊনবিংশ শতকের শুরুতে পরিচালিত তার জরিপের প্রতিবেদনে। 

এই সীতারকোর্ট আর আশুড়ার বিলকে ঘিরে রয়েছে পুরোনো কাহিনি। কথিত আছে অযোদ্ধার অধিপতি রাম তার পত্মী সীতাকে পঞ্চবটির বনে (বর্তমান জাতীয় উদ্যান) বনবাস দিয়েছিলেন। সীতার থাকার জন্য একটি কুঠির তৈরি করে দেন। এ কুঠিরে সীতা থাকতেন। সীতার সঙ্গে থাকত পুত্র লব।

নবাবগঞ্জ উপজেলা কারিগরি কলেজের অধ্যক্ষ আবু হেনা মোস্তফা কামাল  জানান, বছর বিশেক আগেই পুরো বিল জুড়ে ফুটে থাকতো লাল শাপলা। শীতে অতিথি পাখির কলরবে থাকতো মুখরিত। বন আর বিলের অপরূপ সেই সৌন্দর্যের স্বাদ নিতে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসতেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। উত্তরাঞ্চলের শিক্ষাসফরসহ নির্মল বিনোদনের অন্যতম স্থান ছিল জাতীয় উদ্যান ঘেরা আশুড়ার বিল। কিন্তু  ধীরে ধীরে দখলদারের কবলে পড়ে সৌন্দর্য্য হারিয়ে ফেলেছে সেই আশুড়ার বিল। মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকেন সৌন্দর্য আর ভ্রমণ পিপাসুরা। হারিয়ে গেছে লাল-সাদা শাপলা। বন্ধ হয়েছে অতিথি পাখিদের আনাগোনা। 

নবাবগঞ্জ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মো. শাফিকুল ইসলাম জানান, প্রাক্তন ইউএনও মো. মশিউর রহমান অব্যাহতভাবে অভিযান চালিয়ে আশুড়ার বিল থেকে উচ্ছেদ করেছেন দখলদারদের। গুঁড়িয়ে দিয়েছেন অবৈধ স্থাপনা। নিজেই বিলের কাদা পানিতে নেমে করেছেন কচুরিপানা পরিষ্কার। স্থানীয় এমপি ও প্রশাসনের সহযোগিতায় নির্মাণ করেছেন ব্যতিক্রমী শেখ ফজিলাতুন্নেছা কাঠের সেতু। এর আগে আশুড়ার বিলের পাশ দিয়ে লাগানো হয়েছে পাঁচ হাজার সৌন্দর্য বর্ধনকারী গাছ। পাখিদের অভয়াশ্রম করতে বনের মাঝে পাঁচ হাজার মাটির হাড়ি ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। বিলে লাগানো হয়েছে লাশ-সাদা শাপলা।  বিএডিসির মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়েছে ক্রস ড্যাম। 

স্থানীয়দের অভিযোগ গত জানুয়ারিতে ইউএনও মশিউর রহমান অন্যত্র বদলি হয়ে যাবার পরেই একদল দৃষ্কৃতি, দখলদার ক্রস ড্যামের বাঁধটি কেটে দেয়। এতে করে শুকিয়ে যায় আশুড়ার বিলের পানি। শুরু হয় বিল দখলের প্রতিযোগিতা। 

কুশদহ ইউপি চেয়ারম্যান সায়েম সবুজ জানান, বর্তমান ইউএনও নাজমুন নাহার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ নির্মাণ করেছেন। বিল ও বন থেকে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু করেছেন। বাঁধ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছেন। স্থানীয় এমপি শিবলী সাদিকের সহযোগিতা ও পরামর্শে আশুড়ার বিলকে একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

ইউএনও নামজুন নাহার জানান, একই সঙ্গে বিল ও  গভীর সবুজ শালবনের সংমিশ্রন অমূল্য সম্পদ। এ সম্পদের সঠিক পরিচর্যায় প্রাকৃতিক যে সৌন্দর্য তৈরি হতে পারে বিশ্বের অন্যতম তীর্থ কেন্দ্র। এটিকে বিশ্বমানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি গড়ে তুলতে তিনি সার্বিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত  ক্রস ড্যামের বাঁধ সংষ্কারের কাজ হাতে নিয়েছেন। ফলে এখন প্রতি বছর আশুড়ার বিলে থাকবে পানি। লাল সাদা শাপলা আর পদ্মে ভরে থাকবে বিল। বাড়বে দেশীয় মাছের বংশ। এছাড়া নববাগঞ্জে অব্যাহতভাবে কমতে থাকা ভূগর্ভের পানির স্তর ঠিক রাখবে। এসব কার্যক্রমের ফলে এরইমধ্যেই স্মরণাতীতকালের বেশি পর্যটকের আগমন ঘটেছে এই আশুড়ার বিলে। ব্যাপক সংখ্যক পর্যটককে ঘিরে এলাকাবাসীর মধ্যে দেখা দিয়েছে কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত। 

Place your advertisement here
Place your advertisement here