• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook

তাজমহল তৈরির পেছনে শাহজাহানের প্রেম ছিল না

দৈনিক রংপুর

প্রকাশিত: ১৩ নভেম্বর ২০১৮  

Find us in facebook

Find us in facebook

আমরা আগ্রা দূর্গের বিভিন্ন গঠন নিয়ে আলোচনা করেছি। অনেক বলেন তাজকেও নাকি হার মানায় এটি। একবার আগ্রা ফোর্ট দেখলে আর ভালো লাগে না কোনো কিছুই। আগ্রা ফোর্টের দেয়ালে দেয়ালে কারুকাজ।

আবাসনের পাশাপাশি রাজ পরিবারের বিনোদন, গান-নাচের আসর, রাজকার্যের জন্য দরবার হল কী নেই এখানে। তবে এই প্রাসাদের নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল একেবারে ভিন্ন। যদিও তাজমহল আর আগ্রা ফোর্টের নাম একই সঙ্গে শোনা যায় তবে এর নির্মাণ হয়েছে আরো অনেক আগে। প্রকৃত অর্থেই, আগ্রা দূর্গ ছিল একটি দূর্গ। এর ইতিহাস বদলেছে সেই ইব্রাহিম লোদী থেকে শুরু করে বাবর, হুমায়ূন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, আওরঙ্গজেবের হাত ধরে। একে দূর্গের জটিল অবয়ব দেন সম্রাট আকবর। তবে এর গঠন সর্বোচ্চ নান্দনিকতা পায় শাহজাহানের হাতে। সেনাদের দূর্গকে তিনি পরিণত করেন রাজপ্রাসাদে। যমুনার তীরে নির্মিত দূর্গটির চারদিকে এমনভাবে দেয়াল তোলা হয়েছে যাতে বোঝা না যায় কোনটা ঠিক এর প্রবেশ পথ। দেয়ালের গঠন আর নকশার চাতুর্যই এর কারণ। রাজা মানসিং এর রাজপুত ফোর্টের নির্মাণ শৈলীর সঙ্গে এর মিল রয়েছে। পরে আবার আগ্রা ফোর্টের আদলে তৈরি হয় দিল্লীর লাল দূর্গ। আকবর যখন শাসনভার নেন তখন তিনি পেয়েছিলেন এর ধ্বংসাবশেষ। তার ইতিহাসবিদ আবুল ফজল জানান এর নাম ছিল বাদলগর। এরপর রাজস্থান থেকে লাল বেলেপাথর এনে তিনি পুননির্মাণ করেন এটি। তবে শাহজাহানের ভালবাসা ছিল সাদা মার্বেলের প্রতি। তাই দূর্গের ভেতরে ভবন নির্মাণে তিনি ব্যবহার করেছেন শ্বেতপাথর। সম্রাজ্ঞী যোধা বাই এর ভবনটি লাল, কারণ এর নির্মাতা আকবর। অন্যান্য ভবনগুলোর নাম জাহাঙ্গীর-ই মহল, খাস মহল, দরবারই খাস, আর শীষ মহল। আগ্রা ফোর্টের আকর্ষণের কেন্দ্রে রয়েছে এর শিষ মহল। হাম্মাম অর্থাৎ রাজ গোসলখানায় অসাধারণ ওয়াটার ইঞ্জিয়ারিং করা হয়েছে। সম্ভবত পানি গরম করার জন্য ল্যাম্প ব্যবহার করা হত এখানে। মার্বেলের চেয়েও দামী আয়না দিয়ে খচিত শিষ মহলের দেয়াল। শতকোটি প্রতিবিম্ব চোখ ধাঁধিয়ে দেবে আপনার। আগ্রা ফোর্টের নিচে আছে ফাঁপা সুড়ঙ্গ, যার মধ্য দিয়ে যমুনার পানি বয়ে যেত। ফলে সমগ্র মহলটি থাকত ঠান্ডা। বিশাল এলাকা জুড়ে দূর্গের বিস্তার। রানীরা থাকতেন নিচের দিকের ঘরগুলোতে, যাতে ঠান্ডা আবহাওয়া পেতে পারেন সবসময়। দূর্গের ছাদে বসত গান নাচের আসর। সম্রাটের এবং শিল্পীর জন্য বাঁধানো মঞ্চ দেখতে পাবেন এখনো। আগ্রা ফোর্টেই বন্দী ছিলেন শাহজাহান, সন্তান আওরঙ্গজেব বন্দী করে রেখেছিলেন তাকে। নিজ প্রাসাদ থেকে তিনি দেখতে পেতেন যমুনার ওপারে তাজমহলকে। স্মৃতিচারণ করতেন প্রিয় সহধর্মিনী মমতাজকে। যোধা বাই এর মহল থেকেও তাজকে দেখা যায়। তবে কালের বিবর্তনে যমুনার জল আর নেই তেমন। আগ্রা ফোর্টের নির্মাণ শৈলীতে হিন্দু সংস্কৃতির ছাপ রয়েছে সুস্পষ্ট। হাতি, পাখি, ড্রাগনের প্রতিমূর্তি বা ছবি ইসলাম স্থাপত্যে দেখা যায় না। কিন্তু আগ্রা ফোর্টে আপনি পাবেন তার দেখা। আগ্রা ফোর্টের আরেকটি বিশেষত্ব হল, এটির মাঝে শুধু নারীদের নামাজ পড়ার জন্য আলাদা মসজিদ আছে। এর নাম নাগিনা মসজিদ।

এবারে চোখ রাখি তাজমহলের দিকে। কিন্তু তার আগে আমাদের জানতে হবে এক মহিয়সী নারীর কথা যার সৃষ্ট স্থাপত্য রীতি নাকি তাজমহলের স্থাপত্য নকশার অনুপ্রেরণা ছিল। এই নারীর নাম নুরজাহান। সম্রাট জাহাঙ্গীরের কুড়িতম স্ত্রী। মুঘল সম্রাজ্ঞী নুরজাহান ছিলেন আঠারো শতকের ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারীদের একজন। জন্মের সময় তার নাম দেওয়া হয়েছিল মিহরুন নিসা। ষোড়শ শতকের শুরু থেকে পরবর্তী প্রায় ৩০০ বছর ধরে ভারতবর্ষ শাসন করেছেন মুঘলরা। তারা ছিলেন ভারতের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী রাজবংশ। কিন্তু পুরো মুঘল রাজবংশের একমাত্র নারী শাসক নুরজাহানকে নিয়ে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে এখনও ছড়িয়ে রয়েছে অনেক লোকগাথা।নুরজাহানের প্রেম, তার সাহসিকতার অনেক কাহিনি ছড়িয়ে আছে। মুঘল প্রাসাদের অন্দরমহলে তার রাজনৈতিক ক্ষমতা, প্রতিপত্তি এবং আকাঙ্খা সম্পর্কে বিস্তারিত খুব কমই জানা যায়।নুরজাহান ছিলেন একজন কবি, দক্ষ শিকারি এবং খুবই সৃজনশীল এক স্থপতি। আগ্রায় তার তৈরি নকশাতেই নির্মাণ করা হয়েছিল তার বাবা-মার সমাধিসৌধ। পরে এই স্থাপত্য রীতিই নাকি তাজমহলের স্থাপত্য নকশার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। সম্রাটের হারেমে তার উত্থান ঘটে এক দূরদর্শী রাজনীতিক হিসেবে। তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের সবচেয়ে প্রিয়তম স্ত্রীতে পরিণত হন। বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য আসলে তিনি ও সম্রাট জাহাঙ্গীর মিলে একসঙ্গেই শাসন করতেন।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্মৃতিকথায় ১৬১৪ সালের পর থেকে তার সঙ্গে নুরজাহানের বিশেষ সম্পর্কের উল্লেখ রয়েছে বার বার। তিনি নুরজাহানের এক অনুরাগময় চিত্রই একেঁছেন তাতে। নুরজাহান সেখানে বর্ণিত হয়েছেন একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী, চমৎকার সেবাদাত্রী, বিজ্ঞ পরামর্শদাতা, দক্ষ শিকারি, বিচক্ষণ কূটনীতিক এবং শিল্পবোদ্ধা হিসেবে।তাঁদের বিয়ের পরপরই নুরজাহান প্রথম যে রাজকীয় ফরমান জারি করেছিলেন তা ছিল এক রাজকর্মচারীর জমির অধিকার রক্ষায়। সেখানে তিনি স্বাক্ষর করেন নুরজাহান পাদশাহ বেগম নামে, যার অর্থ নুরজাহান, সাম্রাজ্ঞী। তিনি যে সার্বভৌম এবং তার ক্ষমতা যে বাড়ছে, এটি ছিল তারই ইঙ্গিত। একজন রাজকর্মচারী একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলেন তার লেখায়। নুরজাহান একদিন রাজপ্রাসাদের বারান্দায় দেখা দিয়েছিলেন। এটি এর আগে পর্যন্ত কেবল পুরুষদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল।

নাহ। তাজমহলে যাওয়ার আগে আগ্রার আরো কিছু জায়গা দেখা যাক। প্রথমে আকবরের সমাধি। মোঘল সম্রাটদের জীবদ্দশায় নিজের সমাধিস্থল নির্ধারণ করে যাওটা ছিলো শখের বিষয়। সম্রাট আকবর নিজের সমাধিস্থল হিসেবে চয়ন করেন সিকান্দ্রাকে। তখন জায়গাটা ছিলো জনমানবহীন নির্জন একটি জঙ্গল। বেশ নিরিবিলি হওয়ায় জায়গাটা হয়তো সম্রাটের খুব পছন্দ হয়েছিলো। জঙ্গল পরিষ্কার করে ১৬০৬ সালে ১১৯ একর জমিজুড়ে সৌধের নির্মাণকাজ শুরু করেন। কিন্তু কাজ সমাপ্ত হওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৬১৩ সালে তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেন পুত্র জাহাঙ্গীর। সিকান্দ্রা গেটের প্রধান সড়কের পাশেই এর অবস্থান। প্রবেশের জন্যে পায়ে চলা পথ। দুপাশে সারি সারি বাগান। পাখিদের কলকাকলিতে মুখর চারপাশ। মূল গেট হুবহু তাজমহলের গেটের মতোন সুবিশাল। লাল বেলে পাথরে নির্মিত। অসাধারণ কারুকার্য খচিত। চারপাশ চারটে উঁচু মিনার। প্রতিটি গেটেই রয়েছে অসাধারণ সুন্দর নকশা, যা লাল-নীল বা সোনালী রঙের পাথর দিয়ে তৈরি। গেট থেকে মর্মর পাথরে নির্মিত বড় একটি রাস্তা চলে গেছে সমাধিস্থল বরাবর। দুপাশে বিশাল খালি প্রান্তর। সমাধিস্থলের সামনে একটি স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা। চারপাশে বড় বড় বারান্দা। সমাধির সৌধটি বিশাল আকৃতির। পুরোটাই শ্বেতপাথর, লালপাথর ও জেডপাথরে তৈরি। মুঘল সম্রাটদের অন্যান্য স্থাপত্যের মতো এর দেয়ালগুলোও সুন্দর কারুকার্য খচিত। প্রবেশপথের দেয়ালে সুরা মুলক খোদাই করে লেখা হয়েছে। মূল কবর একটি অন্ধকারচ্ছন্ন কক্ষের ভেতর। কবরটি মর্মর পাথরে আবৃত। কবরের গায়ে কুরআনের কয়েকটি আয়াত লেখা। আকবর চেয়েছিলেন, তার সমস্ত বংশধরের কবর এখানে হবে। কিন্তু তার সে আশা তার সন্তানেরা পূর্ণ করেনি। একেক জনের সমাধি একেক জায়গায় হয়েছে। পুত্র জাহাঙ্গীর শুয়ে আছেন লাহোরে, শাহজাহান তাজমহলে, আওরঙ্গজেব আওরঙ্গাবাদে, বাহাদুর শাহ রেঙ্গুনে আর বাবর আফগানিস্তানে। বারান্দা ঘেঁষে দুপাশে আরো তিনটে কবর। শিলালিপির লেখা পড়ে বুঝলাম, আকবরের এক বোন এবং শাহজাহানের এক ছেলে ও এক মেয়ের সমাধি এগুলো। সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিশ্রাম করার ঘরটি এখনও আছে। নাম কাঁচমহল। শোনা যায়, কাঁচমহল যে পাথর দিয়ে তৈরি তার থেকে রাতের বেলা রঙিন আলো বের হতো। একসময় এতে ছিলো কাচের কারুকাজও। সময়ের গর্ভে হারিয়ে গেছে অনেক সৌন্দর্য।

একটু আগে নুরজাহানের কথা বলেছিলাম। সম্রাট জাহাঙ্গীরের বেগম। ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীর থেকে ফিরে আসার পথে জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হয় এবং লাহোরের নিকটে শাহদারাতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। এর আগে ১৯২২ সালে জাহাঙ্গীরের কনিষ্ঠ পুত্র খুররম বিদ্রোহ করে ক্ষমতা দখলের মতলব করলে তা কঠিন হাতে দমন করেন জাহাঙ্গীর। কিন্তু তার মৃত্যুর পরে নূরজাহান তড়িঘড়ি করে নিজ জামাতা ও সম্রাটপুত্র শাহরিয়ারকে সম্রাট ঘোষণা করতে চান। কিন্তু তার ভাই আসফ খান নিজ জামাতা জাহাঙ্গীরের ছোটছেলে খুররমকে সিংহাসনে বসাতে কৌশলে নূরজাহানকে কারাবন্দী করেন। খুররম পথের কাঁটা, নিজ ভাই শাহরিয়ারকে হত্যা করে ‘শাহজাহান’ নাম নিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন। জীবনের শেষ ১৮টি বছর নূরজাহানের বন্দীদশাতেই কাটে। এই পুরো সময় তিনি রাজনীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে, তার পিতার সমাধিতে দরগাহ তৈরির তদারকি করে ও কাব্যচর্চা করে দিনাতিপাত করেন। এই সমাধিটি বর্তমানে ইতমাদ-উদ-দৌলার সমাধি নামে পরিচিত। যে পারসিক কাব্যটি এ সময় তিনি লিখেন, তার নাম হলো ‘মাখফি’। ১৬৪৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর ৬৮ বছর বয়সে নূরজাহান পরপারে পাড়ি জমান। লাহোরের শাহদারা বাগে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সমাধির অদূরেই নূরজাহানের সমাধি। তার কবরের উপরে খচিত আছে, “এই নগন্য আগন্তুকের কবরের উপর না কোনো প্রদীপ থাক, না কোনো গোলাপ। না কোনো প্রজাপতির পাখা পুড়ুক, না কোনো বুলবুলি গান গাক।”

শ্বশুর আসফ খানের কূটনৈতিক কৌশলের বদৌলতে ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ‘আবুল মুজাফ্ফর শিহাবুদ্দীন মুহম্মদ শাহজাহান’ উপাধি নিয়ে শাহজাহান আগ্রার সিংহাসনে আরোহণ করেন। শাহজাহানের যুগে মুঘল স্থাপত্য এর স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে। পূর্ববর্তী মুঘল সম্রাটদের নির্মাণশৈলী থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন শাহজাহান। তার স্থাপনায় রঙ আর আড়ম্বরের প্রাচুর্য ছিল লক্ষণীয়, অবকাঠামোগত দিক দিয়েও ছিল এসব স্থাপনা ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি উন্নত। বিদেশী স্থাপত্যরীতির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় তার নির্মাণে। শাহজাহানের পূর্বে স্থাপত্যশিল্পে লাল পাথরের ব্যবহার ছিল বেশি। এর সাথে সম্রাট বহুমূল্য শ্বেত মর্মর পাথরের ব্যবহার শুরু করেন। কোনো কোনো শিল্প সমালোচকের মতে এই ধারা ভারতীয় প্রচলিত প্রথা থেকে সরে আসা হলেও সৌন্দর্যের বিচারে তা ছিল তুলনাহীন।সম্রাট জাহাঙ্গীর যেমন চিত্রকলায় পারদর্শী ও সুবিখ্যাত ছিলেন, তার পুত্র শাহজাহান তেমনি পারদর্শী ছিলেন স্থাপনাশিল্পে।

শাহজাহানের বয়স তখন ২০ বছর। একদিন আগ্রার বাজার দিয়ে যাওয়ার পথে হঠাৎ শাহজাহানের চোখ চলে যায় পরমা সুন্দরী এক মেয়ের দিকে। আরজুমান্দ বেগম নামের মেয়েটির বয়স ১৪। প্রথম দেখাতেই আরজুমান্দ বেগমকে ভালো লেগে যায় শাহজাহানের। পরবর্তীতে ১৬১২ খ্রিস্টাব্দের ১০ মে মমতাজের বিয়ে হয় যুবরাজ সম্রাট শাহজাহান সঙ্গে। আরজুমান্দ পরিবর্তন করে শাহজাহান তার নাম রাখেন মমতাজ মহল। ১৬৩১ সালের জুন মাসে দাক্ষিণাত্যের বুরহানপুরে সম্রাটের ১৪তম সন্তানকে প্রসবকালে মমতাজ মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে মমতাজ মহল মারা যান। বলা যায়, শাহজাহান নিজে মমতাজের মৃত্যুকে ডেকে এনেছিলেন, বোধহীনের মতো এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। গর্ভবতী মমতাজকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যুদ্ধযাত্রা করেন। দুর্গম রাস্তা দিয়ে হাতির পিঠে বসে দীর্ঘক্ষণ চলার দরুন সময়ের আগেই মমতাজের প্রসববেদনা শুরু হয়। দীর্ঘ ৩০ ঘন্টার সেই প্রসবব্যথা শেষে সন্তান জন্ম দিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মমতাজ, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে। শাহজাহান তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন, মমতাজের মৃত্যুর পর আক্ষেপ, অনুতাপে সাতদিন সাতরাত শাহজাহান কিছু খান নি। ঘর থেকেও বার হন নি। স্ত্রী হারানোর শোকে মুহ্যমান শাহজাহান তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর স্মৃতির জন্য একবছর পরেই নির্মাণ শুরু করেন ভালবাসার এক অপরূপ নিদর্শন তাজমহল।

জনমানসে প্রেমের নিদর্শন হিসেবে তাজমহল প্রতিভাত হলেও সত্যি কি এই নির্মাণে শাহজাহানের প্রেমের সামান্যতম অংশ ছিল ? অনেক ইতিহাস গবেষকের মতে সম্রাট শাহজাহানের তাজমহল তৈরির পেছনে মমতাজের প্রতি প্রেমের কোন স্পর্শই ছিল না। শাহজাহান ছিলেন স্থাপত্য নির্মানে ব্যাপক আকুল, বলা যায় এটা তার নেশায় পরিণত হয়েছিলো। তার ধ্যানে মনে কামনা ছিলো তিনি এমন অপরূপ এক স্থাপত্য তৈরি করবেন যা তার নামকে অমর করে রাখবে শতাব্দীর পর শতাব্দী।

মমতাজের আগেও সম্রাট শাহজাহানের আরও ১ জন স্ত্রী ছিলেন এবং মমতাজকে বিয়ে করার পরও সম্রাট শাহজাহান আরও তিনটি বিয়ে করেন। এমনকি মমতাজ মারা যাওয়ার পর শাহজাহান মমতাজের আপন ছোট বোনকে বিয়ে করেন। সম্রাট শাহজাহান নিজের মেয়ে জাহানারার প্রেমকে জঘন্য উপায়ে কবর দিয়েছিলেন। জাহানারা যার প্রেমে পড়েছিলেন শাহজাহান তাকে একেবারেই পছন্দ করেন নি। কিন্তু বিদূষী জাহানারা প্রেমে অটল ছিলেন।তার প্রেমিক লুকিয়ে তার সাথে দেখা করতে আসতো। শাহজাহান একদিন মেয়ের প্রেমিককে আটক করতে সক্ষম হন। তারপর মেয়ের চোখের সামনেই মেয়ের সেই প্রেমিককে তক্তা দিয়ে দেয়ালের সাথে আটকে পেরেক গেঁথে গেঁথে খুন করেন ‘প্রেমের’ তাজমহলের নির্মাতা শাহজাহান। যমুনার তীরে তখন তাজমহলের নির্মাণ কাজ চলছিল।

তাজমহলের নির্মাণ কাজ মুমতাজের মৃত্যুর পর শুরু হয়। মূল সমাধিটি সম্পূর্ণ হয় ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে এবং এর চারদিকের ইমারত এবং বাগান আরও পাঁচ বছর পরে তৈরি হয়।তাজমহল তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী নকশার উপর, বিশেষ করে পারস্য ও মুঘল স্থাপত্য অনুসারে। তাজমহলের সামনের চত্বরে একটি বড় চারবাগ (মুঘল বাগান পূর্বে চার অংশে বিভক্ত থাকতো) করা হয়েছিল। ৩০০ মিটার X ৩০০ মিটার জায়গার বাগানের প্রতি চতুর্থাংশ উচু পথ ব্যবহার করে ভাগগুলোকে ১৬টি ফুলের বাগানে ভাগ করা হয়। মাজার অংশ এবং দরজার মাঝামাঝি আংশে এবং বাগানের মধ্যখানে একটি উঁচু মার্বেল পাথরের পানির চৌবাচ্চা বসানো আছে এবং উত্তর-দক্ষিণে একটি সরল রৈখিক চৌবাচ্চা আছে যাতে তাজমহলের প্রতিফলন দেখা যায়। এছাড়া বাগানে আরও বেশ কিছু বৃক্ষশোভিত রাস্তা এবং ঝরনা আছে

তাজমহল এর চত্বরটি বেলে পাথরের দুর্গের মত দেয়াল দিয়ে তিন দিক থেকে বেষ্টিত। নদীর দিকের পাশটিতে কোন দেয়াল নাই। এই দেয়াল বেষ্টনির বাইরে আরও সমাধি রয়েছে যার মধ্যে শাহজাহানের অন্য স্ত্রীদের সমাধি এবং মুমতাজের প্রিয় পরিচারিকাদের একটি বড় সমাধি রয়েছে। এ স্থাপত্যসমূহ প্রধানত লাল বেলে পাথর দ্বারা তৈরি, দেখতে সেসময়কার ছোট আকারের মুঘল সাধারণ সমাধির মতন।

তাজমহলে ঢোকার প্রধান ফটক বা দরজাও তৈরি হয়েছে মার্বেল পাথরে। দরজাটির নকশা ও ধরন মুঘল সম্রাটদের স্থাপত্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তাজমহল নির্মান কাজ শুরু হয় ১৬৩২ সালে যা শেষ হয় ১৬৫৩ সালে।

মসজিদটির প্রাথমিক নকশা শাহজাহানের তৈরি অন্যান্য ইমারতের মতই। তাজমহলের মূলে হল তার সাদা মার্বেল পাথরের সমাধি। তাজমহল নিয়ে খুব বিশদে আলোচনার মানে নেই। কারন এই স্থাপত্য নিয়ে অনেকেই অনেক শব্দ লিখে ফেলেছেন। বরং যাওয়া যাক এই বিখ্যাত স্থাপত্য শেষ হওয়ার পরের ঘটনায়।

১৬৫৭ খ্রস্টাব্দে শাহজাহান গুরুতর পীড়ায় অসুস্থ হলে এক পর্যায়ে গুজব রটে যে, তিনি জীবিত নেই। কিন্তু পরে তিনি জীবিত আছেন জানা গেলেও তার পুত্রগণের মধ্যে সিংহাসনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ শুরু হয়। রোগাক্রান্ত অবস্থায় শাহজাহান একটি উইল করে জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। মমতাজ মহলের ৪ পুত্র ছিল। দারা ছিলেন সর্বজ্যেষ্ঠ। তিনি নামেমাত্র পাঞ্জাবের শাসনকর্তা থাকলেও তিনি আগ্রায় অবস্থান করে রাজকর্মে পিতাকে সাহায্য করতেন। তিনি হিন্দুদের প্রতি মিত্র ভাবাপন্ন এবং শিয়াদের প্রতি উদার ছিলেন। শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সুজা ছিলেন বাংলার শাসনকর্তা। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ ও যোদ্ধা হলেও বাংলার আবহাওয়া তাকে আয়েশী, দুর্বল ও স্থবির করেছিল। উত্তরাধিকার সংগ্রামে শাহ সুজা ছিলেন আওরঙ্গজেবের শেষ প্রতিদ্বন্দ্বী। শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেব ছিলেন সর্বাপেক্ষা অধিক শক্তিশালী ও প্রতিভাসম্পন্ন। তার নিষ্কলুস চরিত্র ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভে সহায়তা করেছিল। তিনি বিদ‘আত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। নিজে গান-বাজনায় দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও তা শোনা ত্যাগ করেন। পৌত্তলিক ও বিদ‘আতী উৎসবাদি বাতিল করেন। রহিত করেন শির নত করা এবং মাটিতে চুমু খাওয়া। যা পূর্বতন রাজন্যবর্গের জন্য করা হত। বিপরীতে তিনি ইসলামী সম্ভাষণ-বাক্য তথা ‘আসসালামু ‘আলাইকুম’-এর মাধ্যমে অভিবাদন জানানোর নির্দেশ দেন। শাহজাহানের চতুর্থ পুত্র মুরাদ ছিলেন গুজরাটের শাসনকর্তা। অত্যধিক ভোগবিলাসী ও মদের প্রতি আসক্ত হওয়ায় তিনি আওরঙ্গজেবের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিলেন। বাবর, হুমায়ন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান সকলেই আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সংঘটিত সংঘর্ষে জয়লাভ করে সিংহাসন লাভ করেছিলেন। কাজেই উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব শাহজাহানের পুত্রগণের মধ্যে সংঘটিত হওয়া ছিলো অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা মাত্র।

শাহজাহানের দারার প্রতি অন্ধ স্নেহ ও পক্ষপতিত্ব এ দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ ছিল। শাহজাহান সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেও স্বহস্তে রাজ্যভার গ্রহণ না করে দারাকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন। ১৬৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সর্বপ্রথম বাংলার শাসনকর্তা সুজা স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজ নামে খুৎবা ও মুদ্রাঙ্কন করে সসৈন্য আগ্রা দখল করতে অগ্রসর হন। ১৬৫৭ সালের ডিসেম্বর মাসে মুরাদও নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। সুচতুর আওরঙ্গজেব এসময় কোনো পদক্ষেপ প্রহণ না করে সুযোগের প্রতীক্ষায় থাকেন। যাহোক, ১৬৫৮ সালে বাহাদুর গড়ের যুদ্ধে সুজা, দারা কর্তৃক প্রেরিত বাহিনী দ্বারা পরাজিত হয়ে বাংলায় পলায়ন করেন। এ অবস্থায় আওরঙ্গজেব বুরহানপুর থেকে সসৈন্য যাত্রা করে উজ্জয়নীর নিকট মুরাদের সাথে মিলিত হয়ে ধর্মাটের যুদ্ধে দারা কর্তৃক প্রেরিত বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। এ দুঃসংবাদে ক্ষিপ্ত হয়ে দারা তাদের বিরুদ্ধে ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে স্বয়ং অগ্রসর হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সামুগড়ের যুদ্ধে দারা সম্পূর্ণ পরাজিত হন। এরপর আওরঙ্গজেব সরাসরি অগ্রসর হয়ে রাজধানী আগ্রা অধিকার করে পিতাকে আগ্রার দুর্গে নজরবন্দী রেখে স্বহস্তে শাসনভার গ্রহণ করেন। সম্রাট শাহজাহানও তার যৌবনে পিতা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, জাহাঙ্গীর করেছিলেন তার পিতা আকবরের বিরুদ্ধে। কিন্তু আওরঙ্গজেবের সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশি ছিল এবং প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিলেন যথেষ্ট দক্ষ।

শাহজাহানকে তার জীবনের শেষ ৮ বছর আগ্রার দুর্গে গৃহবন্দি হয়ে থেকেই কাটাতে হয়। এখান থেকেই সম্রাট শাহজাহান অপলক চোখে তাকিয়ে থাকতেন তাজমহলের দিকে । এখানেই তার মৃত্যু হয়। স্ত্রী মমতাজের পাশে তাজমহলেই শাহজাহানকে সমাহিত করা হয়। আমাদের আগ্রা পর্ব শেষ। এবার দ্রুত ফিরব দিল্লিতে।

Place your advertisement here
Place your advertisement here