• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook

মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া শব্দ এবং জয় বাংলা

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৭ মার্চ ২০২২  

Find us in facebook

Find us in facebook

অজিত কুমার সরকার 

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালির মুক্তির সড়ক নির্মাণে অনন্য দূরদর্শী ভাষণ। যুগসৃষ্টিকারী এই ভাষণ বিশ্বের সেরা ভাষণগুলোর একটি। বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ ও মানবজাতির আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে এই ভাষণ প্রেরণাদায়ী এবং বিশ্ব ইতিহাসের অবিস্মরণীয় উপাদান। কিন্তু এ ভাষণের তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিক রয়েছে।

প্রায় প্রতিটি বাক্যই গভীর অর্থবোধক, যা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ভাষণের ভাব, ভাষা ও শব্দ চয়নে উঠে এসেছে একটি জাতির শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস এবং এ থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘ সংগ্রাম এবং জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা।

‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না’—এই বাক্যটির যদি বিশ্লেষণ করা হয় এতে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার মানুষের সঙ্গে চরম বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। তারা বাঙালিদের ওপর শাসন-শোষণের স্টিমরোলার চালায়। চাকরি, সরকারি ব্যয় বরাদ্দসহ সব কিছুতে বাঙালিরা ছিল উপেক্ষিত। তাদের দাবিয়ে রাখার জন্য যা কিছু করার তার সবই করে পাকিস্তানি শাসকরা। কিন্তু একটি জাতিকে কত দিন দাবিয়ে রাখা যায়? বঙ্গবন্ধু স্পষ্টতই জানিয়ে দিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। ’ বাক্যটিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। বাঙালিরা যে জেগেছে, রয়েছে সে বার্তাও। আবার আঞ্চলিক শব্দেরও ব্যবহার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু প্রমিত বাংলা ব্যবহার না করে ‘দাবায়া’ বা ‘পারবা না’ এরূপ আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ করেছেন। কারণ এ শব্দগুলো প্রচণ্ড শক্তিশালী এবং সাধারণ মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া শব্দ।

এমনিভাবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কমপক্ষে ২৯টি বাক্যের বিশদ ব্যাখ্যা করা যায়। এ প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছে মূলত উচ্চ আদালতের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ মন্ত্রিপরিষদে জাতীয় স্লোগান হিসেবে অনুমোদন পাওয়া ‘জয় বাংলা’ নিয়ে আলোচনার জন্য। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাসংগ্রামের ডাক দেন। বক্তব্য শেষ করেন ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণ করে। তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। ’ এর আগে ১৯৭০ সালের গণ-অভ্যুত্থানে জিন্দাবাদের পরিবর্তে জয় বাংলা স্লোগান দেওয়া হয়। ওই বছর ৫ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছয় দফাকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে। ছাত্ররা ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’ স্লোগানের পাশাপাশি ‘জয় বাংলা, তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ স্লোগান দেয়। ২২ জানুয়ারি ১৯৬৯ গণ-অভ্যুত্থানের চাপে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দিত করে এই জয় বাংলা স্লোগানে। একাত্তরের পুরো মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে রাজপথ মুখরিত হয় জয় বাংলা স্লোগানে। আর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তা পরিণত হয় সর্বজনীন স্লোগানে।

কিন্তু জয় বাংলা কি শুধুই একটি স্লোগান? নিশ্চয়ই না। জয় বাংলা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি, মূলমন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার রক্ষাকবচ। জয় বাংলা বলতে বোঝানো হয়েছে বাংলার জয় বা জয় হোক বাংলার। জয় বাংলাকে স্লোগান হিসেবে ব্যবহার শুরু হয় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ শিরোনামে লেখা কবিতা থেকে এনে। ১৯২২ সালে কালিপদ রায় চৌধুরীর অনুরোধে কবি নজরুল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার মাদারীপুরের পূর্ণ চন্দ্র দাসের কারামুক্তি উপলক্ষে কবিতাটি লেখেন। এ কবিতার পঞ্চম প্যারায় লেখা হয়, ‘জয় বাংলার পূর্ণ চন্দ্র/জয় জয় আদি-অন্তরীণ!/জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি/আদি-অন্তহীন। ’ কবিতাটিতে বাংলার সেই সব বিপ্লবীর চেতনার কথা তুলে ধরেছেন, যাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শিকল ভাঙার জন্য আন্দোলন করছেন। বাঙালিরা কবি নজরুলের স্লোগানই ব্যবহার করেছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতাসংগ্রামে।

গভীর বিশ্লেষণে দেখা যায়, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিই আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জাতীয় সত্তার রক্ষাকবচ হয়ে ওঠে। এই ধ্বনি সম্প্রদায়গত বিভেদরেখা ডিঙিয়ে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ সব জাতিসত্তাকে ঐক্যবদ্ধ করে। অথচ ভারতে ‘বন্দে মাতরম’ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের শক্তিশালী স্লোগান হলেও তা কিন্তু সম্প্রদায়গত বেড়া ডিঙাতে পারেনি। ঊনবিংশ শতাব্দীর ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৮৮২ সালে লেখা ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে ব্যবহৃত ‘বন্দে মাতরম’ গান জনপ্রিয়তা পায়। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশরা যখন বঙ্গভঙ্গের চেষ্টা করেছিল তখন এই গান গেয়েই তার বিরোধিতা করা হয়। কিন্তু আনন্দমঠ উপন্যাসটি নিয়ে খোদ ভারতেই প্রবল সমালোচনা রয়েছে। সমালোচনাকারীদের মতে, উপন্যাসটি তৎকালীন হিন্দু সমাজের রেনেসাঁ বা নবজাগরণ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে রচিত। এ কারণে এই উপন্যাস থেকে নেওয়া ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগান বা গান সর্বজনীন হতে পারেনি। এ নিয়ে আজও বিতর্ক চলছে।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপরীতে আন্দোলনের এক পর্যায়ে জয় বাংলা স্লোগান সামনে নিয়ে আসেন। গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় সাড়ে তিন হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য উপাদান অসাম্প্রদায়িকতা। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান একসঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করেছে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকরা রাজনীতিতে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। ভাষা আন্দোলন শুরু হলে তারা প্রচার করে এ আন্দোলন ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত। ছয় দফাকে বলে ভারতের প্রেসক্রিপশন। আর জয় বাংলা স্লোগানের সঙ্গে জয় হিন্দ স্লোগানের তফাত নেই বলে প্রচার করে। এসব সাম্প্রদায়িক তৎপরতা ও অপপ্রচারের বিপরীতে বঙ্গবন্ধু বাঙালিত্ববোধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে জাগ্রত রাখায় সচেষ্ট হন। তিনি নিজ দল আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দেওয়ায় উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া আওয়ামী মুসলিম লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিলের দ্বিতীয় দিনে ‘মুসলিম’ শব্দ প্রত্যাহার করে নামকরণ করা হয় আওয়ামী লীগ। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবিতে যে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শুরু হয় তার সঙ্গে গণতন্ত্র, শোষণ-বৈষম্য, ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিও যোগ করেন। ১৯৭০ সালের প্রতিটি নির্বাচনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ বলে বক্তৃতা শেষ করেছেন। জয় বাংলা ধ্বনি দিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম জয় বাংলাকে কটাক্ষ করে নানা প্রতিবেদন ছেপেছে। সাম্প্রদায়িক অপতৎপরতা ও অপপ্রচার ছাপিয়ে জয় বাংলারই জয় হয়।

কিন্তু দুঃখজনক হলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রথম উদ্যোগটি ছিল ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি মুছে ফেলার। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ক্ষমতায় এসে জিন্দাবাদের প্রবর্তন করতে সচেষ্ট হয়। দীর্ঘ ২১ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন থেকে তারা দেশকে পাকিস্তানি ধারায় পরিচালিত করে। জয় বাংলা ও বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু পারেনি। মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জয় বাংলা ধ্বনি শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন সত্তার রক্ষাকবচ জয় বাংলা ও বঙ্গবন্ধু। শুধু জয় বাংলা স্লোগান উচ্চারণ করে নয়, জয় বাংলা যে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন সত্তার রক্ষাকবচ তা হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। সাম্প্রদায়িকতার মূলোৎপাটন করতে হবে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও বাসসের সাবেক সিটি এডিটর

Place your advertisement here
Place your advertisement here