• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook

দিল্লির চিঠি: বন্ধুত্বের নতুন বার্তা

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৪ অক্টোবর ২০২১  

Find us in facebook

Find us in facebook

জয়ন্ত ঘোষাল

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৫তম জন্মদিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চিঠি দিয়ে তাঁর দীর্ঘ জীবন কামনা করেছেন। শেখ হাসিনার এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাঁকে আততায়ীরা প্রায় ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করেছিল। এতদসত্ত্বেও তিনি বিশ্বসন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন।

এবার এই জন্মদিনের শুভেচ্ছাবার্তা যখন নরেন্দ্র মোদি পাঠালেন তার ঠিক আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৈঠক করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে। নিউ ইয়র্কের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তাঁর যাওয়ার কথাই ছিল; কিন্তু ওয়াশিংটনে বাইডেনের সঙ্গে শুধু বৈঠক নয়, তার পাশাপাশি কোয়াড গোষ্ঠীর দেশগুলোর বৈঠকও এবার বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। এবার নরেন্দ্র মোদি ওয়াশিংটনে গিয়ে আফগানিস্তানে তালেবান সরকার গঠনের পরিপ্রেক্ষিতে বাইডেনের সঙ্গে আলোচনা করলেন। চীনের সাম্প্রতিক সময়ের কার্যকলাপ এবং তার মোকাবেলায় নানা দিক থেকে আলোচনা হলো। অনেকে জানেন না, সুদূর আমেরিকায় বাইডেনের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে নানা রকম ফলোআপ বৈঠক হয়েছে। সেখানে ঘুরেফিরে উঠে এসেছে বাংলাদেশের কথা। বাংলাদেশ কেন ভারতের পাশাপাশি আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র, সেই বিষয়ে নরেন্দ্র মোদি ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেখানে।

আসুন, এবার আমরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মার্কিন সফরের এই দিকগুলো নানা দিক থেকে আলোচনা করি। 

প্রথম কথা হলো, নরেন্দ্র মোদি এবার কিন্তু আমেরিকায় গিয়ে যে বক্তৃতাটা দিয়েছেন সেখানে তিনি বারবার গণতন্ত্রের কথা বলেছেন অর্থাৎ ভারতের শক্তি ‘গণতন্ত্র’। ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যে সম্পর্ক এবং সেই দেশগুলোতে গণতন্ত্রের মহিমা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই গণতান্ত্রিক শক্তি দিয়েই এই মুহূর্তে বিশ্বে সন্ত্রাসের মোকাবেলায় ভারত শক্তিশালী হবে। আরো উল্লেখযোগ্য বিষয়, নরেন্দ্র মোদির সুরে সুর মিলে গেছে যখন বাইডেন তাঁর বক্তব্য পেশ করেছেন। সেখানেও তিনি বারবার বলার চেষ্টা করেছেন ‘ডেমোক্রেসি ক্যান ডেলিভার’ (Democracy can deliver)অর্থাৎ ‘গণতন্ত্র’ দিয়েই এই পৃথিবীর সমস্যার সমাধান হবে।

নরেন্দ্র মোদি কেন ‘গণতন্ত্র’ বিষয়টির ওপর এত জোর দিয়েছিলেন? মোদি ফিরে আসার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রসচিব তাঁরা বিষয়টি সাংবাদিকদেরও বোঝানোর চেষ্টা করেছেন এবং আমি নিজে সাউথ ব্লক সূত্রে যা জানতে পারলাম তাতে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এবার যে ‘কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ’ (Quadrilateral Security Dialogue) হয়েছে জাপান, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত এই চারটি দেশের মধ্যে। এই ‘কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ’ গোষ্ঠীটা কিন্তু কোনো সামরিক গোষ্ঠী নয় এবং এই গোষ্ঠীর মধ্যে কোনো সামরিক চুক্তি হয় না। সেটায় কিন্তু ভারত জোর দিয়েছে। পাশাপাশি এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তারা আফগানিস্তান ও মিডল ইস্ট থেকে সরে এসে ইন্দো-প্যাসিফিক প্রায়রিটির দিকে সচেষ্ট হয়েছে এবং এই ইন্দো-প্যাসিফিক প্রায়রিটি দেওয়ার জন্য তারা ‘অকাস’ (Aukus)তৈরি করেছে। তাতে ব্রিটেন, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া আছে। ব্রিটেন বরাবরই আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখেছে। টনি ব্লেয়ার যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন ঠাট্টা করে বলা হতো, টনি ব্লেয়ার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে গেছেন। কিন্তু এখন অনেক দিন পর আবার ব্রিটেন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াকে সঙ্গে নিয়ে একটা গোষ্ঠী তৈরি করল এবং এটা সামরিক শক্তি। কেননা নিউক্লিয়ার সাবমেরিন তৈরির ব্যাপারে তারা চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। অস্ট্রেলিয়াকে সঙ্গে নেওয়ায় ফ্রান্স রেগে গেছে এবং ফ্রান্স আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধিতা করেছে অস্ট্রেলিয়ার এই অন্তর্ভুক্তীকরণে। কেননা ফ্রান্সের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ১২টি সাবমেরিন কেনার ব্যাপারে চুক্তি হচ্ছিল। সেটার কী হবে এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রবেশে ফ্রান্সের পরপরই দেখা গেছে যে জয়শঙ্কর ফ্রান্সের সঙ্গে কথা বলেছেন। ফ্রান্সে গেছেন, এমনকি ভারতের পররাষ্ট্রসচিবও ফ্রান্সের সঙ্গে কথা বলেছেন। সম্প্রতি জয়শঙ্কর দেশে ফেরার পর কিছু সাংবাদিকের সঙ্গে জুমে কনফারেন্স করেছিলেন এবং সেখানে এই প্রশ্নটা উঠেছিল যে ভারত এখন সাবমেরিন নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে কোনো চুক্তি করবে কি না। সে ব্যাপারে জয়শঙ্কর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। হ্যাঁ-না কিছুই বলেননি। তাতে জল্পনা-কল্পনাটা আরো একটু উসকেই দিয়েছেন তিনি; যদিও কোনো কনফারমেশন তিনি দেননি। এখন এই পরিস্থিতিতে ‘অকাস’ তৈরি হলো। আমেরিকা বলছে যে দক্ষিণ চীনের সমুদ্রপথে যেহেতু চীন নানা রকমের ‘থ্রেট পারসেপশন’ (Threat perception)করছে এবং তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর তার কাছাকাছি হংকংয়ের মাধ্যমে যেভাবে ‘থ্রেট পারসেপশন’ তৈরি করছে, তার জন্য এই রকম একটা গোষ্ঠী করার দরকার ছিল। এই সামরিক গোষ্ঠীতে না থাকায় ভারতকে কি অবজ্ঞা করা হয়েছে?

আসলে সাউথ ব্লকের কর্তারা যেটা আমাকে বললেন যে এটা ভারতের জন্য ভালো হয়েছে। কেননা এই যে নানা ধরনের গোষ্ঠী তৈরি করা এটা ট্রাম্প নেননি। ট্রাম্প চিৎকার করতেন, মাঝরাতে টুইট করতেন, নর্থ কোরিয়ার সঙ্গে প্রায় যুদ্ধ ঘোষণা করে ফেলেছিলেন, বাইডেন কিন্তু সেটা করছেন না। বাইডেন চীনের সঙ্গে প্রযুক্তিগত, আর্থিক, বাণিজ্যিক লড়াই এবং চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছেন। ওবামার আত্মজীবনীতে পড়েছি, ওবামা চীনে গিয়েও বলেছিলেন যে নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। সেটা বাণিজ্যিক দিক থেকেই, তবেই পরিস্থিতিটা এগোতে পারে। চীনের সঙ্গে যুদ্ধটা এখানে ঠিক সামরিক যুদ্ধ নয়। সামরিক যুদ্ধের প্রস্তুতি থাকে কিন্তু আসল লড়াইটা প্রযুক্তির। এখন চীনেরও  আমেরিকার ওপর নির্ভরশীলতা রয়েছে। অর্থাৎ উৎপাদন চীন করলেও আমেরিকান কম্পানিগুলো তো চীনে গিয়ে কাজ করছে। ‘অ্যাপল’ তো আমেরিকান কম্পানি। ম্যানুফ্যাকচারিংটা চীনের হলেও কম্পানি আমেরিকার। আমেরিকা ওখান থেকে এই কম্পানিগুলো আস্তে আস্তে সরিয়ে নিচ্ছে। ‘অ্যাপল’-এর মতো বহু সংস্থা সেখান থেকে চলে আসবে। এখন আমেরিকা যেটা চাইছে যে এই প্রযুক্তিগত নির্ভরশীলতা যদি কমাতে হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে অন্য যে দেশগুলো, সেখানে ভারতের যে প্রযুক্তিগত উৎপাদন তার ওপর নির্ভরশীলতা আমেরিকা বাড়াবে। আবার ভারত মনে করছে যেটা নরেন্দ্র মোদি বারবার বলার চেষ্টা করেছেন, সে ক্ষেত্রে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ অনেকটা এগিয়ে গেছে। সুতরাং আগামী দিনের যে প্রযুক্তি তাতে যে শুধু বাণিজ্য নয়, সাপ্লাই চেইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানে কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (Artificial intelligence) থেকে শুরু করে ‘ফাইভজি’ যে প্রযুক্তি এগুলোয় কিন্তু অনেক কাজকর্ম করছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। সুতরাং আমেরিকা থেকে যেমন আসবে, তেমন ভারত, বাংলাদেশ, জাপান তারাও কিন্তু এ ব্যাপারে সাহায্য করবে। চীনও কিন্তু বুঝতে পারছে এই সমস্যাটা। এখন চীন ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর (Belt and Road Initiative)জন্য অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। এখন সেখানে অনেক লোকসান বেড়েছে, কভিডের জন্য অনেক কাজকর্ম বন্ধ আছে এবং সেখানে চীন বুঝতে পারছে এখন সেটা করার সময় নয়। উল্টো জাপান, তাইওয়ান ও আমেরিকা তারা তিনজনে একটা ত্রিভুজ তৈরি করেছে এবং সেখানে জাপানের সঙ্গে আমেরিকার যে রকম একটা প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে আবার তাইওয়ানের সঙ্গেও জাপানের একটা চুক্তি আছে। এর ফলে একটা নতুন ডিফেন্স তৈরি হচ্ছে এবং চীনের জন্য বেশ সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

সুতরাং আমেরিকা কখনোই তাইওয়ানকে আক্রমণ করার সুযোগ দেবে না। এখন আমেরিকার যে রণকৌশল, সেই রণকৌশলটা আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর। যেটা চীন ভেবেছিল যে আফগানিস্তানে তালেবানকে বোঝাবে, চীনে যাতে কোনো তালেবানি জঙ্গি আক্রমণ না হয় এবং চীন আফগানিস্তানের বৈধতার জন্য ইউনাইটেড নেশনে (United Nations)লড়াই করবে; কিন্তু তার বদলে আফগানিস্তানে তালেবানি শক্তি আইএসআইয়ের (ISI)সাহায্য নিয়ে অন্য দেশে তারা যা ইচ্ছা করুক। এমনকি ভারতে করলেও কিছু যায়-আসে না। কিন্তু চীনকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। এখন ক্রমেই বোঝা যাচ্ছে, নতুন তালেবান সরকার যদি এখনই কোনো বড়সড় সন্ত্রাসের মধ্যে যায়, তাহলে সারা বিশ্বের কাছে তারা আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ফলে চীন আর পাকিস্তান শুধু থেকে যাবে। কারণ আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহার হয়ে, যাক ইরান এটাতে রাজি ছিল। এখন ইরানও ভারতকে বলছে, তারা মার্কিন সেনা চলে যাওয়ায় খুশি হয়েছে। কিন্তু তাই বলে পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব হতে পারে না।

ইরানের যে শিয়া-সুন্নির ঝামেলা, সেই কারণে তালেবান ও পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের বন্ধুত্ব হওয়া কঠিন। সে ক্ষেত্রে ইরানের তেল নিয়েও অনেক ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থ আছে। ইরান আবার পাকিস্তানের বিরোধিতার লাইন নিতে শুরু করেছে। মার্কিন সেনা চলে যাওয়ার পর ইরানের এখন কিন্তু তালেবান সরকার নিয়ে সেই উৎসাহটা আর দেখা যাচ্ছে না। এটা নরেন্দ্র মোদি আমেরিকায় গিয়ে বুঝতে পেরেছেন। এখন ইরানের পাশাপাশি তুরস্ক তালেবানকে সমর্থন করলেও তুরস্ক ভৌগোলিকভাবে ভারত ও বাংলাদেশ থেকে অনেকটা দূরে। সেই কারণে ভারতের কাছে তালেবান সরকার গঠনের ফলে যে আশঙ্কাটা দেখা দিয়েছিল এখন সেখানে নতুন সমীকরণ দেখা দিয়েছে। বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের পর নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে। ‘অকাস’ আছে, ‘কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ’ও আছে। আবার ভারত কিন্তু সরাসরি ন্যাটোর সদস্যও হয়নি, সামরিক চুক্তিও করেনি আবার চীনের সঙ্গেও আগামী দিনে তারা কোনো রকম আলোচনা করবে না, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হবে না এমন কোনো পরিস্থিতির কথা ভারত বলেনি। ভারত যেটা করছে, যা কিছু করছে বাংলাদেশকে জানিয়ে করছে। কেননা এই মুহূর্তে প্রতিবেশী অন্য রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের আর্থিক পরিস্থিতি ভালো এবং বাংলাদেশকে  ভারতেরও প্রয়োজন এবং এই মুহূর্তে আমেরিকার মতো বৃহৎ রাষ্ট্র উৎপাদন এবং অন্য বিভিন্ন বিষয়ে চীনকে কোণঠাসা করার জন্য বাংলাদেশের ওপর তারা অনেক বেশি নির্ভরশীল হবে।

সুতরাং এককথায় বলা যেতে পারে, নরেন্দ্র মোদির এই আমেরিকা সফর বাংলাদেশে শেখ হাসিনার জন্মদিনের শুভেচ্ছা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং দুই দেশের মধ্যে এক নতুন বন্ধুত্বের বার্তা নিয়ে এসেছে।

লেখক : নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি।

Place your advertisement here
Place your advertisement here