• রোববার ০৫ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২২ ১৪৩১

  • || ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook

জোবায়েরকে হারিয়ে কাঁদছে গ্রামবাসী

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৩ এপ্রিল ২০২৪  

Find us in facebook

Find us in facebook

ছোটবেলা থেকেই মানুষের বিপদে এগিয়ে যেতেন জোবায়ের রহমান নাজিউল। পরোপকার ছিল এই তরুণের নেশা। কিন্তু সহযোগিতার এমন মনোভাব যে তাঁর মৃত্যুর কারণ হবে, সেটা কেউ ভাবতে পারেনি। এক গৃহবধূ ও তাঁর দেড় বছরের শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তিনি। নিজের জীবন দিয়ে জোবায়ের প্রমাণ করে গেছেন, ‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে’।

জোবায়েরকে নিয়ে গর্ব করে কথাগুলো বলছিলেন তাঁর আত্মীয় শাজাহান আলী। গাইবান্ধা শহরের এসকেএস স্কুল অ্যান্ড কলেজের এই শিক্ষার্থীর সাহসিকতায় গত সোমবার প্রাণে বেঁচে গেছে এক শিশু; তবে প্রাণ হারিয়েছেন শিশুটির মা আয়েশা বেগম রাজিয়া।গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ভরতখালী গ্রামের দর্জি জাহিদুল ইসলামের ছেলে জোবায়ের। ঘটনার দিন তিনি কলেজের এক শিক্ষকের কাছ থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। গাইবান্ধা পৌর শহরের আদর্শ কলেজ সংলগ্ন এলাকায় রেললাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে ফেরার সময় গৃহবধূ রাজিয়াকে শিশুসহ রেললাইনে দাঁড়াতে দেখে জোবায়ের এগিয়ে যান। তিনি শিশু আবির হোসেনকে ধাক্কা দিয়ে রেললাইনের পাশে ফেলে দেন। কিন্তু রাজিয়াকে নিয়ে লাইন থেকে সরে যাওয়ার সময় ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এতে জোবায়েরের মাথা গিয়ে রেললাইনের পাশের পিলারে ধাক্কা খায়। পরে গুরুতর আহত রাজিয়া ও জোবায়েরের মৃত্যু হয়। ঘটনার দিন রাতে ময়নাতদন্তের পর নিজ নিজ গ্রামে দু’জনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।

জোবায়েরের এমন মৃত্যু মানতে পারছেন না মা-বাবা, স্বজন-প্রতিবেশী। দুই ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে কান্না থামছে না জাহিদুল ইসলাম ও জেবা বেগমের।গত মঙ্গলবার দুপুরে তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের ছাউনি দেওয়া পাকা বাড়ির উঠান ও ঘরে প্রতিবেশী-স্বজনের ভিড়। সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায় জাহিদুল ইসলাম জোবায়েরের জামা আঁকড়ে বিলাপ করছেন। এই জামা পরা অবস্থায় তাঁর একমাত্র ছেলে ট্রেনের ধাক্কায় মারা গেছেন। মা জেবা বেগম আরেক ঘরে বিছানায় শুয়ে আছেন। কাঁদতে কাঁদতে অচেতন হয়ে পড়ছেন তিনি। চেতনা ফিরে পেলে ছেলেকে খুঁজছেন। স্বজনরা পাশে বসে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কারও সান্ত্বনায় জেবা বেগমের মন মানছে না।

একটু পরপর কেঁদে উঠে তিনি বলছেন, ‘আমার কলিজার টুকরাকে আইনে দ্যাও। আমি কত স্বপ্ন দেখিতাম। সে শহরে ভালো স্কুলে ভর্তি হলো। বাবাটা আমার ডাক্তার হবি। এখন মাসে মাসে আমি কাক টাকা পাঠাব? আমার বাবা কেন হামাক ছাড়ি একা চলি গেলো!’

স্বজন ও প্রতিবেশীরা জানান, জোবায়েরকে নিয়ে মা-বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। ছোট থেকেই পড়াশোনায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। বিজ্ঞান বিভাগে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন গাইবান্ধা শহরের এসকেএস স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখানে থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে মাধ্যমিক পাস করেন। এর পর একই কলেজে একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এবার তাঁর এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা আর দেওয়া হলো না। সেই সঙ্গে থেমে গেল চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নযাত্রাও।এলাকাবাসী বলছেন, তাঁর বয়সী ছেলেরা যখন যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যস্ত, জোবায়ের তখন ভাবতেন মানুষের জন্য কী করা যায়, তা নিয়ে। এই ভাবনা থেকেই ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলা চেম্বারের সদস্য হন। জোবায়েরের ফেসবুক পোস্ট ঘুরে দেখা যায়, গত ২৬ জানুয়ারি স্থানীয় একটি বৃদ্ধাশ্রম পরিদর্শন করে সংগঠনটি। সেই ছবি ফেসবুকে দিয়ে তিনি লেখেন, ‘প্রতিটি হাসিই অমূল্য, আপনাদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরে আমরা আনন্দিত।’

জোবায়েরের সঙ্গে চার বছর ছাত্রাবাসের একই কক্ষে থেকেছেন সহপাঠী লোকমান মাসুদ। জোবায়ের সব সময় মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাইতেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জোবায়ের শুধু আমার বন্ধুই ছিল না, সে একজন ভাইও। কখনও আমার বা কারও সঙ্গে তার মনোমালিন্য হয়নি। সে সাধ্যমতো সবার উপকার করত। সে পড়াশোনায় যেমন ভালো ছিল, তেমন ভালো ছিল ক্রিকেটে। খুব ভালো ব্যাটিং করত। তার স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু তার আগেই আমরা তাকে হারিয়ে ফেললাম।’গৃহবধূ রাজিয়ার শ্বশুরবাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। তিনি সদর উপজেলার মধ্য গোবিন্দপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী। গতকাল মাঝিপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, শিশু আবির কান্না করছে। একবার দাদি মঞ্জুরি রানী, আরেকবার বাবা আনোয়ার হোসেন তাকে কোলে নিয়ে ধামানোর চেষ্টা করছেন।

আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ছেলের গায়ে হাত তোলায় রবিবার রাতে রাজিয়াকে একটু মারধর করি ও গালি দিই। রাতেই সে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। পরে আমার ছেলেসহ অন্য রুমে ঘুমায়। সকালে আমি কাজে যাই। পরে দুপুরে শুনি আমার স্ত্রী ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা গেছে। তাকে ছাড়া একা এই শিশুসন্তানকে কীভাবে বড় করব!’

Place your advertisement here
Place your advertisement here