• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

Find us in facebook

দিনাজপুরের রাম সাগর জাতীয় উদ্যান ঘিরে সম্ভাবনা

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১ ডিসেম্বর ২০২২  

Find us in facebook

Find us in facebook

উত্তরবঙ্গের প্রথম জাতীয় উদ্যান দিনাজপুরের রামসাগরের উন্নয়ন নেই অনেক বছর। রয়েছে অনেক সমস্যা। রামসাগরে ঘুরতে আসা পর্যটক, সুবিধাভোগী এবং বিভাগীয় বন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে জানা গেছে। আর এই সমস্যা ছাপিয়ে শিগগির উন্নয়নের মুখ দেখবে এই পর্যটনকেন্দ্রটি- এমনটিই আশাবাদ সংশ্লিষ্টদের।

রামসাগর কোনো সাগর নয়, তবুও দেশের সবচেয়ে বড় এই দিঘির নাম রামসাগর। এর সৌন্দর্যের বিশালতা সাগরের মতোই। তাই এটিকে লোকজন দিঘি নয় সাগর বলতেই পছন্দ করেন।

রামসাগরের নীলাভ জলরাশি, দিঘির চারপাশ ঘিরে সবুজের বেষ্টনী, লাল মাটির উঁচু-নিচু টিলা আর অপরূপ নৈসর্গ প্রকৃতিপ্রেমী ও ভ্রমণপিপাসুদের নিমিষেই মুগ্ধ করে।

এই দিঘি ঘিরেই গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে ছোট জাতীয় উদ্যান ‘রাম সাগর জাতীয় উদ্যান’। দূর থেকে দেখে রাম সাগরকে অরণ্য বলেও মনে হতে পারে।

দিনাজপুরের রাজ বংশের অনন্য ইতিহাস ধারণ করে টিকে থাকা ঐতিহাসিক রাম সাগরের সৌন্দর্য অবলোকনে প্রতিনিয়তই এখানে আসেন দেশি-বিদেশি অসংখ্য পর্যটক। কিন্তু দিন দিন পর্যটকদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।

রাম সাগরের চারপাশজুড়ে লাল মাটির উঁচু-নিচু টিলা রয়েছে। এসব টিলায় জন্মেছে নানান প্রজাতির ফলদ, বনজ ও ঔষুধি গাছ। দিঘির চারপাশ ঘিরে চলাচলের জন্য রয়েছে ইট দিয়ে তৈরি হিড়িমবম্ব সড়ক। সড়কের বিভিন্ন প্রান্তে সারিবদ্ধভাবে লাগানো হয়েছে নানা জাতের সুগন্ধি ফুলের গাছ। এছাড়া রাম সাগরের নীল জলরাশি ঘেঁষে পশ্চিম অংশের উঁচু টিলায় গড়ে তোলা হয়েছে মনোরম ডাকবাংলো।

রাম সাগর জাতীয় উদ্যানে রয়েছে একটি চিড়িয়াখানা। এটি দিঘির পশ্চিম প্রান্তে দক্ষিণ কোনে অবস্থিত ডাকবাংলো ঘেঁষা। চিড়িয়াখানার সংগ্রহও কম নয়। এখানে রয়েছে অজগরসহ কয়েক প্রজাতির সাপ, বানর, পাখি, চিত্রা হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণী।

চিড়িয়াখানার পাশেই ছিমছাম শিশু পার্ক। সেখানে শিশুদের খেলার বিভিন্ন সরঞ্জামের পাশাপাশি রয়েছে কৃত্রিমভাবে তৈরি বিভিন্ন প্রাণী।

রাম সাগরের পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে প্রায় ৬ হাজার বর্গফুট আয়তনের পাথরের ঘাট। বড় বড় আকারের বেলে পাথর দিয়ে ঘাটটি নির্মিত। কেউ কেউ এটিকে সান বাঁধা ঘাট বলেন।

রাম সাগর দিঘির আয়তন ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৪৯২ বর্গমিটার। দিঘিটির প্রস্থ ৩৬৪ মিটার ও গভীরতা গড়ে প্রায় ১০ মিটার (প্রায় ৩৩ ফুট)। এর পাড়ের সর্বোচ্চ উচ্চতা প্রায় ১৩ দশমিক ৫০ মিটার।

দিনাজপুর শহর থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে আউলিয়াপুর ইউনিয়নের তাজপুর গ্রামে এই রামসাগর। দিঘির পাড়ে আম, জাম, কাঁঠাল, সেগুন, আমলকী, হরীতকী, দেবদারু, জারুল, কাঞ্চন, নাগেশ্বর, কাঁঠালিচাঁপা, বটসহ ১৫২ রকমের গাছ দাঁড়িয়ে আছে। রয়েছে হরেক রকমের ফুল গাছ। ১৯৬০ সালে এই দিঘিকে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে আনা হয়। ১৯৯৫ সালে রামসাগরকে আধুনিক পর্যটনকেন্দ্র এবং ২০০১ সালে রামসাগরকে ঘিরে গড়ে ওঠা বনকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

রাম সাগর জাতীয় উদ্যান ঘিরে সম্ভাবনা
উপরোক্ত সমস্যাগুলো সমাধানের পাশাপাশি বন্ধ ক্যান্টিনগুলো চালু করতে হবে। ভেঙে পড়া সীমানা প্রাচীরগুলো নির্মাণ করে পর্যটকদের চলাচল নিরাপদ করতে পারলে পর্যটক আরও বাড়বে। টুরিস্ট পুলিশের উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে পারলে এবং পর্যটকদের জন্য প্রকৃতিকে ঠিক রেখে রাতযাপনের ব্যবস্থা এবং চাঁদনী রাত উপভোগ করার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে রাজস্ব বাড়বে। ওভারব্রিজটি করতে পারলে দর্শনার্থী বাড়বে এবং রাম সাগরে বেড়াতে এসে পানি আর বন দেখে একঘেয়েমি কাটাতে পারবেন।

সমস্যা এবং সম্ভাবনা নিয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বশিরুল আল মামুন বলেন, উত্তরবঙ্গের প্রথম জাতীয় উদ্যান রামসাগর দিঘী। বনের সমস্যা এবং সম্ভাবনাগুলোকে আমরা চিহ্নিত করেছি। প্রকৃতির ন্যূনতম ক্ষতিসাধন করে কীভাবে রামসাগর জাতীয় উদ্যানের উন্নয়ন করা যায় তা নিয়ে কাজ করছি। এরই মধ্যে আমরা একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি, যা অনুমোদনের অপেক্ষায়। উন্নয়ন পরিকল্পনাটি দীর্ঘমেয়াদি। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এবং রুটিন ওয়ার্ক হলে রাম সাগর জাতীয় উদ্যান পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।

রামসাগর দিঘির নামকরণের ইতিহাস
এই দিঘি খনন নিয়ে রয়েছে দুই ধরনের পৌরাণিক কাহিনি। একটি আবেগঘন; জল কষ্ট দূর করতে দিঘি খননের পর পানির জন্য রাজ কুমারের জীবন বিসর্জন, অন্যটি জল কষ্ট দূর করতে কাজের বিনিময়ে প্রজাদের খাদ্যের সংস্থানের কথা। তবে নামকরণ নিয়ে এই দিঘির সুনির্দিষ্ট কোনো লিখিত প্রমাণ নেই। যা আছে, তা লোকমুখে প্রচলিত কাহিনি।

এর একটি হচ্ছে- ১৭২২-১৭৬০ পর্যন্ত দিনাজপুরের রাজা ছিলেন রাজা প্রাণনাথ। পলাশীর যুদ্ধের কিছুকাল আগে তিনি এই দিঘি খনন করিয়েছিলেন। রাজা প্রাণনাথের শাসনামলে একবার দেশজুড়ে দীর্ঘ সময় অনাবৃষ্টি আর খরা দেখা দেয়। খাদ্য ও পানির অভাবে পড়ে মানুষ। রাজা সিদ্ধান্ত নেন একটি দিঘি খনন করবেন। মাত্র ১৫ দিনের মাথায় হাজার হাজার শ্রমিক দিন-রাত পরিশ্রম করে বিশালাকার এই দিঘি খনন করলেন। কিন্তু দিঘিতে পানির দেখা পাওয়া গেলো না। পরদিন রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হলেন, তার একমাত্র ছেলে রামনাথকে সেই দিঘির মাঝখানে বলি দিলেই দিঘিতে পানি উঠবে। রাজা ছেলেকে জানালেন স্বপ্নের কথা। প্রজাদের কষ্টের কথা চিন্তা করে বাবার প্রস্তাবে সাড়া দিলেন রাম। দিঘির মাঝখানে নির্মাণ করা হলো মন্দির। বলি হওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন রাজপুত্র। দিঘির সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দিঘিতে পানি ওঠা শুরু হলো। একসময় পানিতে টইটম্বুর হলো দিঘি। রাজপুত্র তলিয়ে গেলেন দিঘির অতলে। পানিতে ভেসে রইলো রাজমুকুট। সেই থেকে দিঘির নাম হলো রামসাগর।

অপরটি হচ্ছে দিনাজপুর অঞ্চলের রাজা রামনাথ ১৭৫০-১৭৫৫ সালে প্রজাদের সেচ সুবিধা, পানির কষ্ট লাঘব ও কাজের বিনিময়ে প্রজাদের খাদ্যের সংস্থানের লক্ষে রাজা রামনাথ ঐতিহাসিক এ দিঘিটি খনন করান। দিঘিটি খনন করতে তৎকালীন প্রায় ৩০ হাজার টাকা ব্যয় হয় এবং কথিত আছে ১৫ লাখ শ্রমিক এই দিঘি খনন করেন। পরে তার নামানুসারে দিঘির নাম হয় রাম সাগর।

কীভাবে যাবেন
অনিন্দ্য সুন্দর রাম সাগর দিঘি দেখতে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যাতায়াত করা সম্ভব। ব্যক্তিগত যান ছাড়াও দেশের যেকোনো জেলা থেকে বাস বা ট্রেনে আসা যায় দিনাজপুরে। ঢাকা থেকে বাসে এসি ১ হাজার ৩০০ এবং ননএসি ৯০০ টাকা ও ট্রেনে সরাসরি দিনাজপুর শহরে আসতে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে এসি চেয়ার ৯৩০, স্নিগ্ধা ৭৭৫ এবং নন-এসি শোভন চেয়ার ৪৬৫ টাকা।

চাইলে ঢাকা থেকে বিমানে আসা যায় সৈয়দপুর। সেখান থেকে বাসে বা অন্যান্য যানে দিনাজপুর। এরপর দিনাজপুর শহর থেকে দক্ষিণ দিকে রাম সাগর মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরত্বের পথ। শহর থেকে ইজিবাইকে যাওয়া যায় আড়াইশ বছরের পুরাতন দিঘিটি দর্শনে। শহরের কাচারি ঘুণ্টি মোড় থেকে রাম সাগর মোড় পর্যন্ত জনপ্রতি ইজিবাইকে ভাড়া পড়বে ২০ টাকা।

থাকার ব্যবস্থা
রাম সাগর দর্শনে গিয়ে সেখানে থাকার জন্য রাম সাগরের অভ্যন্তরে ডাকবাংলো রয়েছে। এজন্য বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করতে হবে। শহরের হাউজিং মোড়ে রয়েছে পর্যটন মোটেল। মোটেলের ঢাকার প্রধান কার্যালয় থেকেও এখানকার কক্ষ বুকিং দেওয়া যায়। এছাড়া শহরের স্টেশন রোড, গণেশতলা, চারুবাবুর মোড়, মালদহপট্টি, নিমতলা এলাকায় আবাসিক হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে ১০০-৫০০ টাকার মধ্যে রাতযাপনের সুযোগ রয়েছে।

কোথায়, কী খাবেন
খাসি-মুরগির মাংস ও বড় আকারের মাছের জন্য শহরের নিমতলার মুন্সি হোটেল, হাঁসের স্পেশাল মাংসের জন্য লক্ষ্মীতলা হাট, গরুর মাংসের জন্য শহরের সিঅ্যান্ডবি মোড় এলাকার রুস্তম হোটেল প্রসিদ্ধ। এছাড়া শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট-বড় বিভিন্ন মানের খাবারের হোটেল রয়েছে।

Place your advertisement here
Place your advertisement here