• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook

জীবনজুড়েই অন্ধকার কুড়িগ্রামের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিউলির

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১০ জানুয়ারি ২০২২  

Find us in facebook

Find us in facebook

প্রতিটি নবজাতক জন্মের পর পৃথিবীর আলো দেখে। আলোমাখা রোদের পরশ নিয়ে ধীরে ধীরে বড় হয়ে আলোকিত করে সমাজকে। ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য দেখে বুঝে নিজেকে সাজায় আপন গতিতে। একটা সুন্দর জীবন গড়তে অবিচল চেষ্টা আর স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে চায় সবাই। কিন্তু জন্মের পর দেখার চোখে যদি আলো না ঝড়ে, আজন্ম দৃষ্টিহীন হয়ে সমাজের অবহেলিত জীবন নিয়ে বাঁচতে হয়। তাহলে সে জীবন কি আর কোনো পূর্ণতা থাকে?

প্রতিটি পদে পদে সমাজের গ্লানি আর তিরস্কারের পাত্র হয়ে জীবনন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকার কোনো অর্থই আসে না। এরপরও অন্ধ জীবন নিয়ে পরিবারকে আগলে রেখে পথচলা এক নারীর নাম শিউলি। অন্ধ হয়ে জন্ম নেওয়ার পর বাবাকে না পাওয়া। মা অতিকষ্টে ভিক্ষাবৃত্তি করে কোনোরকমভাবে বড় করেন দৃষ্টিহীন শিউলিকে।

স্বামী পরিত্যাক্ত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিউলি বেগম (৩৩)। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের সোবনদহ গ্রামে থাকেন নানা ওসমান আলীর বাড়িতে। এক ছেলে এক মেয়ে ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে তার অভাবের সংসার। দৃষ্টিহীন শিউলির আয় রোজাগার না থাকায় নিত্যদিন খেয়ে না খেয়ে পরিবারের তিন সদস্যকে নিয়ে চরম কষ্টে দিন অতিবাহিত করছেন। পরিবারে এক ছেলে জুয়েল (১০), মেয়ে জুই (৬), ও বৃদ্ধা মা ফিরোজাকে নিয়ে সংসারের ভার যার হাতে, তিনি কি মানসিকভাবে সুস্থ আছেন?

ভূমিহীন পরিবারটির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩২-৩৩ বছর আগে দিনমজুর নানা ওসমানের বাড়ি সোবনদহ গ্রামে জন্ম হয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিউলির। প্রতিবন্ধী সন্তানরা কোনো মায়ের কাছে বোঝা নয়। তেমনই একজন বিধবা মায়ের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়ে শিউলি বেগম। মা অন্যের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করে মেয়েকে লালনপালন করেছেন।

পরে অবশ্য মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে পাশ্ববর্তী একটি গ্রামে ১৫ বছর বয়সে বিয়েও দিয়েছেন মা। সুখে শান্তিতে চলছিল শিউলির সংসার। দীর্ঘ ১০ বছর সংসার জীবনে এক ছেলে ও এক মেয়ের মা হন শিউলি। পরে স্বামী শাহআলম ডিভোর্স দিলে শিউলির আর ঠাঁই হয়নি স্বামীর বাড়িতে। উপায়ন্তু না পেয়ে অবশেষে চলে আসেন বৃদ্ধা মায়ের বাড়িতে। ছেলে-মেয়েকে বাঁচাতে মায়ের সহযোগিতায় শুরু করেন ভিক্ষাবৃত্তি। ভিক্ষাবৃত্তি করেই কোনোরকমভাবে চলছিল তাদের অভাব অনটনের সংসার, জমিয়েছেন সামান্য কিছু টাকাও। 

তবে ৩-৪ বছর আগে সরলমনা এই শিউলী জীবনে নেমে আসে আরেক অধ্যায়। স্বপ্ন নিয়ে আবার বিয়ের পীড়িতে বসেন তিনি। বিয়ে করেন সদরের ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের বাবু নামের এক যুবককে। স্বপ্ন ছিল এই দ্বিতীয় বিয়ে করে সুখে শান্তিতে বাকি জীবন কাটবে তার। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর আশা ভেঙে চুরমার করেন দ্বিতীয় স্বামী বাবু। বিয়ের কিছু দিন পর শিউলির কষ্টার্জিত জমানো টাকা নিয়ে উধাও হয় সেই স্বামী বাবু মিয়া। পরে তারা জানতে পারে বিয়েটিও ছিল ভুয়া। অন্ধ শিউলির জীবনে আবার শুরু হয় হতাশা আর ঘোর অন্ধকার। সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী ভাতা পেলেও তার পরিবারের চার সদস্যের জন্য এটা অতি সামান্য। 

দৃষ্টিহীন শিউলির সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমার জন্ম হয় নানার বাড়িতে। জন্মের পর আমি আমার বাবাকেও দেখি নাই, সূর্যের আলো যে কেমন তাও জানি না। নিজের কোনো জমিজমা নাই। থাকি নানার বাড়িতে। মা আমাকে বড় করে বিয়ে দেয়। দুই ছেলে মেয়ে হওয়ার পর স্বামী আমাকে ডিভোর্স দেয়। মায়ের বাড়িতে এসে দুই সন্তান ও বৃদ্ধা মাকে বাঁচাতে শুরু করি ভিক্ষা করা।

তিনি আরও বলেন, ৩-৪ বছর আগে বাবু নামের এক ছেলে আমাকে ভুয়া বিয়ে করে আমার জমানো কিছু টাকা ছিল নিয়ে পালিয়ে গেছে। এ বিষয়ে আমরা মামলা করলেও হেরে গেছি। আমার ছেলে-মেয়ে ৫টা টাকা চাইলেও দিতে পারছি না। এই যে ঠান্ডার দিন আমার পায়ের জুতাও নাই খালি পায়ে বেড়াই। সন্তানদের ঠান্ডার কাপড়ও নাই। তিনবেলা তাদের খাওয়াতে পারছি না। কী অপরাধ করেছি? আল্লাহ আমাকে এতো কষ্ট দিলো কেন?

শিউলি বলেন, আগে আমার মায়ের সহযোগিতায় ভিক্ষা করতাম। এখন মা চলতে পারে না তাই আর ভিক্ষা করতে পারছি না। কোনো কোনো দিন না খেয়েও থাকতে হচ্ছে আমাদের। কিছু দিন আগে ব্র্যাক নামের একটা এনজিও আমাকে সহায়তা করেছে। আমি খুবই অসুস্থ হয়েছি। কিছু দিন আগে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে জীবন বাঁচাইছে ব্র্যাক। তারা যদি সহোযোগিতায় না করত আমার মরা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। এই অবস্থায় কোথায় যাব, কী করব, কোনো কূলকিনারা পাচ্ছি না।

স্থানীয় জোসনা ও আয়শা বলেন, শিউলির খুবই কষ্ট কারণ সে অন্ধ মানুষ। ওর মায়ের অনেক বয়স হয়েছে। আগে মানুষের বাড়িতে কাজ করত এখন আর তাও করতে পারে না। বয়স হয়েছে এ কারণেই কেউ আর কাজ করতেও ডাকে না। কোনোদিন না খেয়ে থাকে তারা। অন্যের ছেলেরা বিস্কুট খায়, তা দেখে তার ছেলে-মেয়েরা বিস্কুট খাওয়ার জন্য কাঁদে শিউলি দিতে পারে না। আমাদের গ্রামে শিউলিরা সবচাইতে গরিব। এদের দুঃখের শেষ নাই। কেউ যদি সহযোগিতা করত তাহলে মনে কষ্ট কিছুটা কমত তাদের।

ঘোগাদহ ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মালেক সরকার বলেন, তারা গরিব পরিবার। পরিবারে আয় করার মতো কেউ নাই। আমি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিউলিকে ভালোভাবেই চিনি। নিজেদের কোনো জমিও নাই। আমি এর আগেও ওই পরিবারটিকে সবসময় সহযোগিতা করেছি। এবারও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। সরকারিভাবে কোনো সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও তাদের স্পেশালভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করব। এছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিউলির সঙ্গে কথা বলা যাবে ০১৩১৩৩০১৭২৪ এই নম্বরে।

Place your advertisement here
Place your advertisement here