• বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৬ ১৪৩১

  • || ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook

নিজে ক্রিকেটার হতে না পারলেও অন্যকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন মুকুল

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৩ মার্চ ২০২৪  

Find us in facebook

Find us in facebook

ইমরান খান মুকুল। স্বপ্ন ছিল একদিন জাতীয় দলে খেলবেন। তবে অভাবের সংসারে তা আর হয়ে ওঠেনি। জীবিকার তাগিদে চাকরি করছেন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ল্যাব সহকারীর। নিজের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ না হলেও এলাকার প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়ে তুলেছেন ক্রিকেট একাডেমি। শত প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে নিজের অপূর্ণ স্বপ্নকে এখন অন্যের মাঝে বিলিয়ে সফলতার গল্প বুনতে চাইছেন এই যুবক।

সম্প্রতি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার দেউতি পুরাতন মাঠে গিয়ে প্রায় ২০-২৫ জনকে অনুশীলনে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। উঠতি বয়সের এই কিশোর-তরুণদের ক্রিকেটের বিভিন্ন কলাকৌশল শিখিয়ে দিচ্ছেন প্রশিক্ষক ইমরান খান মুকুল।

অনুশীলনের মাঝে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হলে দেউতি ক্রিকেট একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খান মুকুল বলেন, আমার এখানে যারা প্রাকটিস করছেন তাদের মধ্যে অনেকেই ক্রিকেট ভালো বুঝতে শিখেছে। অনেক খেলোয়াড় প্রতিভাবান আছে। শুধু একটু যত্ন আর নিয়মিত নজর রাখলে ওরা ভালো কিছু করবে।

তিনি আরও বলেন, নিভৃত গ্রামগুলোতে অনেক প্রতিভা তৈরি হয় কিন্তু বিকশিত করার জায়গা থাকে না। কেউ কেউ আবার সেই সুযোগই পায় না। আমি সেই জায়গাটা তৈরি করে দিতে চাই। আমার ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। অর্থাভাবে নিজেকে সেভাবে মেলে ধরার সুযোগ কাজে লাগাতে পারিনি। তবে গ্রামের ক্রিকেট অনুরাগী প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের মাঝে আমার স্বপ্নটা ছড়িয়ে দিতে চাই।

দেউতি পুরাতন মাঠের সীমানা প্রচীর নেই। গ্রামের খোলামেলা এই মাঠেই মুকুলের হাতে গড়া ক্রিকেট একাডেমিতে ব্যাট-বলের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন একঝাঁক কিশোর ও তরুণ। তাদের শেখার মাঠে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। জালে ঘেরা নেট নেই, নেই ব্যাটিং-বোলিং শেখানোর উন্নত পিচ। যা আছে তা শুধুই সাহস স্বপ্ন আর প্রচেষ্টা। কিন্তু সেই শেখার মাঠেই কখনো কখনো ব্যাটের তোড়ে ছিটকে যাওয়া বলের আঘাতে ক্ষিপ্ত অনেকেই ছুটে আসেন প্রশিক্ষণ বন্ধ করতে। প্রায়ই উৎসাহ দেওয়ার পরিবর্তে বাধা দেওয়া মানুষদের কারণে বিপাকেও পড়তে হয়। এতকিছুর পরও থেমে নেই প্রশিক্ষণ আর প্রশিক্ষকের প্রচেষ্টা।

এই একাডেমির প্রশিক্ষক ইমরান খান মুকুলের চাওয়া সরকারি বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে এগিয়ে কেউ এগিয়ে আসুক। তবেই ভালো কিছু উপহার দেওয়া সম্ভব অজপাড়াগাঁয়ের এই মাঠ থেকে। মুকুলের বিশ্বাস তার একাডেমির ছেলেরা যদি পরিশ্রমে বিশ্বাসী হয় এখান থেকে অনেক প্রতিভা তৈরি হবে। এখান থেকে আগামীর মাশরাফি, তামিম, সাকিব, মুশফিক ও মুস্তাফিজের মতো প্রতিভাবান খেলোয়াড় বের করে আনা সম্ভব হবে।

অনুশীলন করা অনেক খেলোয়াড় অভাবের সংসারে পড়ালেখার পাশাপাশি ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছা থেকেই নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। তাদের কেউ হতে চান মুস্তাফিজ কিংবা মিরাজ আবার অনেকেই সাকিব হয়ে উজ্জ্বল করতে চায় দেশের মুখ।

মাঠে অনুশীলন করা আব্দুল্লাহ আল-মাহমুদ আপন নামের এক খেলোয়াড় বলেন, আমার মাঝে যে প্রতিভা আছে আমি জাতীয় দলে চান্স পাবো ইনশাআল্লাহ্। আমি এ পর্যন্ত অনেক জায়গায় খেলছি। আমি ইন্টার স্কুল লিগ পর্যন্ত খেলছি। আমার মনে হয় চেষ্টা করলে আমি ভালো জায়গায় পৌঁছাতে পারব। মুস্তাফিজ ও মিরাজের মতো খেলোয়াড়রা কিন্তু অজপাড়াগাঁ থেকেই ওঠে এসেছে। আমার বিশ্বাস আমিও পারব।

সজিব আহমেদ নামে আরেক খেলোয়াড় বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম ভালো ক্রিকেটার হবো। বয়সভিত্তিক দলগুলোতে খেলে খেলে আমি বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলার স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন পূরণের জন্য চেষ্টা করছি, নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। এখন আমাদের একাডেমির জন্য পৃষ্টপোষকতা প্রয়োজন। আমাদেরকে কেউ একটু সহযোগিতা করলে আমরা আগামীতে ভালো কিছু করব ইনশাআল্লাহ।

২০১০ সালে যাত্রা শুরু হয়েছিল দেউতি ক্রিকেট একাডেমি। আর্থিক টানাপোড়েনে ধুকে ধুকে চলে কার্যক্রম। চার বছরের মাথায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় একাডেমিটি। পরে নতুন উদ্যোমে বড় স্বপ্ন নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করা একাডেমিতে এখন খেলোয়াড় প্রায় ৫০ জন। আগামী দিনের ক্রিকেটে রংপুরকে এগিয়ে নেওয়াসহ দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে চাওয়া এই একাডেমির খেলোয়াড়দের এখন প্রয়োজন টিকে থাকার মতো সহায়তা।

একাডেমির খেলোয়াড় শিহাবুল ইসলাম পাভেল বলেন, আমি মূলত মুস্তাফিজ ভাইকে দেখে ক্রিকেট খেলা শিখছি। আমিও বাম হাত দিয়ে বোলিং করি। আমার বাবার স্বপ্ন আছে আমাকে ক্রিকেটার বানাবে। আমাদের পরিবারের অনেক সমস্যা আছে। তারপরও স্বপ্ন দেখেই যাচ্ছি। ক্রিকেট তো অনেক ব্যয়বহুল খেলা। এটা শিখতেও অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। আমাদের একাডেমিতে বল-ব্যাটের সংকট রয়েছে। ভালো কোনো নেট নেই, পিচের অবস্থাও তেমন ভালো না। তারপরও আমাদের প্রশিক্ষক মুকুল ভাই হাল ছাড়েননি।

রাকিব হাসান নামে আরেক খেলোয়াড় বলেন, আমাদের অনেক কিছুর প্রয়োজন হয় প্রাকটিস করতে সেগুলো আমরা সময়মতো পাই না। আমাদের যদি একটা খাঁচা বা জালের নেট হয় তাহলে প্রাকটিস করতে সুবিধা হয়। পিচের অবস্থা ভালো হলে বোলারদের বোলিং প্রাকটিসটা আরও ভালো হতো।

পশ্চিম দেউতি সুন্দরপাড়া গ্রামের মশিউর রহমান। তিনি প্রায়ই মাঠে আসেন এই তরুণদের প্রশিক্ষণ দেখতে। তার ছেলেও মুকুলের একাডেমিতে ক্রিকেট খেলা শিখছেন। এই অভিভাবক বলেন, আমার ছেলেকে আমি বড় ক্রিকেটার বানাতে চাই। ছেলেরও স্বপ্ন সে একজন ভালো ক্রিকেটার হবে। কিন্তু আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য একটু চাপের। তবে যতটুকু পারি ছেলেকে প্রেরণা দেবার চেষ্টা করছি।

তৃণমূলে ছড়িয়ে থাকা এ ধরণের একাডেমিগুলো পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশের ক্রিকেট অগ্রযাত্রায় বড় ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করছেন ক্রীড়া বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড-বিসিবির তত্ত্বাবধানে এসব খেলোয়াড়দের পৃষ্ঠপোষকতা করা গেলে তৃণমূল থেকে অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার উঠে আসবে বলে মনে করেন রংপুর ক্রিকেট একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক ক্রিকেটার শাকিল রায়হান।

রংপুরের অনেক ক্রিকেটার তৈরির এই প্রশিক্ষক বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে চেয়ারম্যান বা কাউন্সিলররা যদি খেলোয়াড়দের সমস্যাগুলো ওপর মহলে জানান তাহলে সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে সহজ হতো। বিসিবি বা ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে সুযোগ সুবিধা সবকিছু আছে নাই বললে ভুল হবে। প্রতিটা জেলায় যদি একটা ইনডোরের ব্যবস্থা করা যেত, ক্রিকেট বোর্ড যদি বিকেএসপির মত প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারতো প্রতিটা জেলায় একটা করে। আমার মনে হয় যে খালি একটা খেলোয়াড় তৈরি হতো না একটা সুন্দর সমাজ গঠন হতো।

Place your advertisement here
Place your advertisement here