• শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪ ||

  • শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

  • || ১৯ মুহররম ১৪৪৬

Find us in facebook
সর্বশেষ:
সর্বোচ্চ আদালতের রায়ই আইন হিসেবে গণ্য হবে: জনপ্রশাসনমন্ত্রী। ২৫ জুলাই পর্যন্ত এইচএসসির সব পরীক্ষা স্থগিত।

হাজী মোহাম্মদ দানেশের নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নেপথ্য

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৫ ডিসেম্বর ২০২৩  

Find us in facebook

Find us in facebook

হাজী মোহাম্মদ দানেশ কে ছিলেন এবং দিনাজপুরের বাঁশেরহাটে কেন তার নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলো এ বিষয়ে জানার আগ্রহ অনেকেরই। হাজী মোহাম্মদ দানেশ ছিলেন অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের একজন কৃষক নেতা। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী যে ক'জন বরণ্যে ব্যক্তির নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে তাদের মধ্যে হাজী মোহাম্মদ দানেশ অন্যতম। ঠাকুরগাঁও তথা বৃহত্তর দিনাজপুরের মেহনতি মানুষের মুক্তি সংগ্রামে এই বিপ্লবী নেতা নিজেকে আজীবন উৎসর্গ করেছেন।

হাজী মোহাম্মদ দানেশ ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির দিনাজপুর জেলার বোচাগঞ্জ থানার সুলতানপুর গ্রামে ১৯০০ সালের ২৭ জুন এক মুসলিম কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ গ্রামে শৈশবে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় হাজী মোহাম্মদ দানেশের।

পরবর্তীতে সেতাবগঞ্জ থেকে প্রবেশিকা, রাজশাহী কলেজ থেকে আই.এ এবং বি.এ পাস করেন। তারপর ১৯৩১ সনে ভারতের উত্তর প্রদেশের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ এবং ১৯৩২ সনে তিনি আইনে বি.এল ডিগ্রি লাভ করেন। আইনে বি.এল ডিগ্রি লাভের পর তিনি প্রথম উকিল হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ঠাকুরগাঁও আদালতে।

পরবর্তীতে তিনি দিনাজপুর জেলার এস.এন কলেজ বর্তমান দিনাজপুর সরকারী কলেজের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেন এবং এক পর্যায়ে দিনাজপুর জেলা আদালতে আইন ব্যবসায় আরম্ভ করেন।

হাজী মোহাম্মদ দানেশ ছিলেন খুব রাজনীতি সচেতন ও স্বাধীনচেতা মানুষ। যার ফলে কৃষক, বর্গাচাষী, ক্রান্তি চাষীদের ওপর জমিদার ও জোতদারদের অত্যাচার দেখে শিশু বয়সেই তার মানসিক চিন্তায় বিপ্লব ঘটে। তিনি ছাত্র জীবনেই কৃষকের ওপর অত্যাচারের প্রতিকার কল্পে কৃষক আন্দোলনে আকৃষ্ট হন। তিনি একাধারে তেভাগা আন্দোলন ও পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা।

তেভাগা আন্দোলনের সুতিকাগার ছিলো উত্তরবঙ্গ। উত্তরবঙ্গ বরাবর জোতদার প্রধান তথা জোতদার শাসিত এলাকা হওয়ায় এই আন্দোলনের উদ্ভব হয় উত্তরবঙ্গে। যারা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও আন্দোলনকে সার্থকতার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে নেওয়ার জন্য মরণপণ চেষ্টা করেন তাদের অধিকাংশ নেতারা ছিলেন উত্তরবঙ্গের। এইসব নেতাদের মধ্যে দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ, রিপন রায় (পার্বতীপুর), বরদা চক্রবর্তী, হেলেকেতু সিং, রূপায়ন রায়, গুরুদাস তালুকদার প্রমুখ নেতারা ছিলেন আন্দোলনের স্বাপ্নিক রূপকার। এদের মধ্য তেভাগা আন্দোলেনের সর্বাধিক ত্যাগী ও তেজস্বী নেতারূপে হাজী মোহাম্মদ দানেশের নামটি প্রবাদ পুরুষে পরিণত হয়। বর্গাচাষিদের অধিকার আদায়ে তিনি উত্তরবঙ্গে তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করেন।

হাজী মোহাম্মদ দানেশ ১৯৩০ এর দশকে কমিউনিস্ট সংগঠনে সক্রিয় হন। তিনি মূলত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক সংগঠনে যুক্ত হন। ১৯৩৮ সালে তেভাগা আন্দোলনে অংশ নেযার জন্য তিনি দুইবার গ্রেপ্তার হন। এছাড়াও তার নেতৃত্বে দিনাজপুর জেলায় টোল আদায় বন্ধ ও জমিদারি উচ্ছেদের দাবিতে কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত তিনি তোলাবার্টি আন্দোলন, সুসংবদ্ধ আন্দোলন, গান্ডি আদায় বন্ধ আন্দোলন,'জাল যার জলা তার' আন্দোলন করেন ও গ্রেফতার হন। তিনি ১৯৪২ সালে বঙ্গীয় কৃষক সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং ১৯৪৫ সালে মুসলিম লীগে যোগদান করেন।

১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ সালের মাঝামাঝি তিনি বাংলাদেশ ও ভারতে পশ্চিমবঙ্গের ১৯টি জেলায় ৬০ লাখ বর্গাচাষি নিয়ে তিন ভাগের দুই ভাগ আদায়ের জন্য জমিদার ও জোতদারদের বিরুদ্ধে মুখোমুখি সংগ্রাম করেন। তিনি মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে ১৯৪৬ সালে কারাভোগ করেন এবং মুক্তিলাভ করেন ১৯৪৭ সালে। এরপর তিনি গণতন্ত্রী দল নামে ১৯৫২ সালে নতুন একটি দল গঠন করেন এবং দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে "গণতন্ত্রী দল" শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টে যোগ দেয় এবং নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টকে পরাজিত করে।

হাজী মোহাম্মদ দানেশের গণতন্ত্রী দল ১৯৫৩ সালে যুক্তফ্রন্টে যোগ দিলে তিনি দিনাজপুর জেলা থেকে পূর্ব বঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে। ১৯৫৭ সালে তিনি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং দলের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। এর পূর্বে তিনি গণতন্ত্রী দলের অস্তিত্ব বিলোপ করেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর তিনি পুনরায় কারা বরণ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৫ সালে পুনরায় কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন।

১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৮০ সালে এই দল বিলোপ করে গণতান্ত্রিক পার্টি নামে নতুন একটি দল গঠন করেন এবং দলের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে গণতান্ত্রিক পার্টি জাতীয় পার্টির সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। তিনি জাতীয় পার্টির অঙ্গ সংগঠন জাতীয় কৃষক পার্টির প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন।

তার এই অকৃত্রিম কৃষক আন্দোলন ও পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনের অসামান্য অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৮৮ সালের ১১ নভেম্বর তার নামে এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন ট্রেনিং সেন্টারকে স্নাতক পর্যায়ে হাজী মোহাম্মদ দানেশ কৃষি কলেজে উন্নীত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কলেজটিকে বিশ্বিবদ্যালয় করার ঘোষণা দেন। যা ৮ জুলাই ২০০১ হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়।

প্রতিশযশা ও বরেণ্য এই কৃষক নেতা ১৯৮৬ সালের ২৮ জুন মৃত্যুবরণ করেন।

Place your advertisement here
Place your advertisement here