• বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৬ ১৪৩১

  • || ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook

ভোটের দিন যেমন পরিবেশ চান নারী ভোটাররা

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৬ জানুয়ারি ২০২৪  

Find us in facebook

Find us in facebook

রংপুর-৫ আসনের ভোটার মারুফা আকতার। মিঠাপুকুরের শঠিবাড়ী এলাকার বাসিন্দা তিনি। ৭ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য কর্মস্থল গাজীপুর থেকে ছুটি নিয়ে গ্রামে ফিরেছেন এই চাকরিজীবী নারী। সর্বপ্রথম ২০০৮ সালে ভোট দিয়েছেন তিনি। তাই ভোটের পরিবেশের সঙ্গে তিনি পরিচিত।

গত বৃহস্পতিবার (৪ জানুয়ারি) বিকেলে শঠিবাড়ী বাজার এলাকায় কথা হয় এই ভোটারের সঙ্গে। এবার ভোটের পরিবেশ নিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। জানিয়েছেন, ২০০৮ সালের পরিবেশটাই চান এবার।

মারুফা আকতার বলেন, প্রথম যেবার ভোট দিয়েছিলাম, সেই পরিবেশটা চাই, যেটা মাঝে পাইনি আমি। পরিবেশটা হবে এমন— এলাকার সবাই দলে দলে ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন। আমরা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকব। কোনো ঝামেলা নেই। আনন্দ নিয়ে একে একে সবাই ভোট দেব।

তিনি আরও বলেন, পাঁচ বছরে একটা ভোট দিতে পারি। সেটাও এখন আর শঙ্কামুক্ত পরিবেশে দেওয়ার নিশ্চয়তা নেই। অথচ ভোট মানে আনন্দ আর চাপা উত্তেজনা বিরাজ করবে চারপাশে। কে জিতবে কে জিতবে টেনশন—এটা অন্যরকম আনন্দ। সেই আনন্দটা আবার ফিরে পেতে চাই।

ভোট দিতে ভীতিমুক্ত নারী সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতের দাবি শুধু মারুফা আকতারের একারই নয়। ভোটের দিন নির্বিঘ্নে বাড়ি থেকে বের হয়ে ভোটকেন্দ্রে ভোটাধিকার প্রয়োগ শেষে আবার নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবেন এমন পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে ভোটে উৎসবের আমেজ থাকবে বলে জানিয়েছেন জেলার নারী ভোটাররা।

সাধারণ ভোটাররা বলছেন, রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) আসন, রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসন এবং রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া ও আংশিক সিটি) আসনে শক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায় ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। একই সঙ্গে এসব আসনে সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কাও চেপে বসেছে তাদের মনে। যদিও এখন পর্যন্ত দু-একটি ছোটখাটো বিশৃঙ্খলার ঘটনা ছাড়া তেমন বড় কোনো ঘটনা ঘটেনি।

রংপুর-২ আসনের তারাগঞ্জ উপজেলা সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা আরজিনা বেগম। তিনি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরি করছেন। এবার দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে প্রস্তুতি নিয়েছেন। কিন্তু সারা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তার রয়েছে নানা প্রশ্ন। তবে ভোটের দিন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকলে ভোটকেন্দ্রে যেতে চান এই ভোটার।

ঢাকা পোস্টকে আরজিনা বেগম বলেন, আমরা সাধারণ ভোটার চাই ভীতিমুক্ত পরিবেশ। ভোটটা যদি ভালো হয়, তাহলে এটা আমাদের সবার জন্যই ভালো। তা নাহলে আমাদেরকে পস্তাতে হবে। শুধু শান্তিপূর্ণ পরিবেশই নয় আমাদের মতো সাধারণ নারী ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন সেটা প্রার্থী ও প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে।

একই কথা জানিয়েছেন বদরগঞ্জ উপজেলার মুচিরহাট এলাকার রাবেয়া সুলতানা। অনার্স পড়ুয়া এই ভোটার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এর আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিয়েছি। তখনও উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মারামারির ঘটনা ঘটেছে। প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা ভোটের পরিবেশ নষ্ট করেছে। এটা তো জাতীয় সংসদ নির্বাচন, এবারই প্রথম আমি ভোট দেব। আমি চাই ভোটটা যাতে সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে নিরাপদে দিয়ে বাড়ি আসতে পারি।

তিস্তা ও ঘাঘট নদী বেষ্টিত গঙ্গাচড়া উপজেলার চরাঞ্চলের ভোটকেন্দ্রগুলো বরাবরই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ভোটকেন্দ্রে বিগত সময়ের নির্বাচনগুলোতে সংঘাত, কেন্দ্র দখলসহ নানা রকম অভিযোগের কথা শোনা গেছে। এবার এই (রংপুর-১) আসনে লাঙ্গল-কেটলি-ট্রাকের প্রতীকের প্রার্থীর মধ্যে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে সংঘাত, সংঘর্ষ এবং ঝুঁকিও। তাই নারী ভোটারদের কণ্ঠে সুষ্ঠু, ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিতকরণে প্রশাসনের শক্ত হস্তক্ষেপের দাবি উঠেছে।

কথা হয় মর্ণেয়ার চরের ভোটার ফরিদা বানু, আকলিমা বেগম, হালিমা খাতুন, রেজওয়া বেওয়াসহ বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে। তাদের কেউ কৃষিকাজ করেন, কেউবা গৃহিণী। এসব ভোটার জানান, বেশির ভাগ প্রার্থী একজন আরেকজনকে আক্রমণ করে নির্বাচনী সভাগুলোতে বক্তব্য দিয়েছেন। কেউ কেউ বিভিন্নভাবে কর্মী-সমর্থক দিয়ে হুমকি-ভয়ভীতি সৃষ্টি করেছেন।

গ্রামের এসব নারী ভোটার বলছেন, ভোটের দিন যাতে তারা নিরাপদে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেন এবং নির্ভয়ে ভোটটা দিতে পারেন সেটা আগে নিশ্চিত করতে হবে। ভোটের দিন সংঘাত, সংঘর্ষ ও হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দেখানোর মতো পরিবেশের সৃষ্টি না হলে তারা সবাই ভোট দিতে যাবেন। শুধু তাই নয় এবার ইভিএমের পরিবর্তে ব্যালট পেপারে ভোট দিতে আগ্রহের কথাও জানান তারা।

এদিকে রংপুর জেলার সবকটি সংসদীয় আসনেই মারুফা, আরজিনা, ফরিদা বানুর মতো অসংখ্য নারী ভোটার রয়েছেন। যাদের ভোট নিয়ে যেমন আগ্রহ রয়েছে তেমনি ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ আর ভয়ভীতি নিয়ে রয়েছে উদ্বেগও।

প্রার্থীরা বলছেন, এরই মধ্যে কেন্দ্রসহ ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টি প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণে সব প্রস্ততি নেওয়া হয়েছে। বিশৃঙ্খলা করলে কেউ ছাড় পাবে না।

রংপুর জেলায় পুরুষের চেয়ে নারী ভোটার বেশি। ভোটার বাড়লেও ভোটকেন্দ্র বিমুখ হয়ে পড়ছেন নারী ভোটাররা। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ক্রমেই ভোটের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়েছেন তারা।

আর সে আগুনে এবারও ঘি ঢেলেছে বিএনপিসহ সমমনা দলের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত। এতে করে ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার আগাম শঙ্কা চেপে বসেছে জেলার এবারের মোট ভোটের অর্ধেকেরও বেশি ভোট ব্যাংকে।

এদিকে ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী রংপুর জেলার মোট জনসংখ্যা ৩১ লাখ ৬৯ হাজার ৬১৫ জন। এর মধ্যে নারী ১৬ লাখ ৬৭ জন এবং পুরুষ ১৫ লাখ ৬৮ হাজার ৬০৮ জন। সবশেষ ভোটার তালিকা অনুসারে জেলার ৬টি সংসদীয় আসনে ২৪ লাখ ৩২ হাজার ৫০৫ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার রয়েছে ১২ লাখ ২০ হাজার ৩৯৪ জন।

নির্বাচন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি প্রায় শেষ করছে স্থানীয় প্রশাসন। এরই মধ্যে রংপুরে ৬টি আসনে নির্বাচনী সরঞ্জামাদি পাঠানো হয়েছে। ভোটের পরিবেশ বিবেচনায় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বা অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ এমন ভোটকেন্দ্রও প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি কার্যালয়ের একটি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছে, জেলার ৬টি আসনে মোট ৮৫৮টি ভোটকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ৩১৫টি কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ বা গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে পুলিশ-আনসারের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি বিশেষ নজরদারি রাখা হবে। একই সঙ্গে বাড়ানো হবে স্ট্রাইকিং ফোর্স ও ভ্রাম্যমাণ টিমের সংখ্যাও। পুরো জেলায় ১ হাজার ৬২০ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন।

জানা গেছে, সাধারণ কেন্দ্রে অর্থাৎ যেসব কেন্দ্রে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার কোনো ধরনের সম্ভাবনা নেই, এসব কেন্দ্রেও পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত থাকবেন।

জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে রংপুর-১ আসনে নয়জন, রংপুর-২ আসনে তিনজন, রংপুর-৩ আসনে ছয়জন, রংপুর-৪ আসনে তিনজন, রংপুর-৫ আসনে আটজন এবং রংপুর-৬ আসনে সাতজনসহ মোট ৩৬ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

জেলায় মোট ভোটার ২৪ লাখ ৩২ হাজার ৫০৫ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার রয়েছে ১২ লাখ ২০ হাজার ৩৯৪ জন। পুরুষ ১২ লাখ ১২ হাজার ৮৭ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ২৪ জন ভোটার রয়েছে। জেলার মোট ৮৫৮টি ভোটকেন্দ্রের ৫ হাজার ১৭৬টি ভোটকক্ষে ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা করেছে নির্বাচন কমিশন।

রংপুর জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে ইতোমধ্যে সকল প্রকার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে কোনো বিশৃঙ্খলা বা অপ্রীতিকর ঘটনায় ছাড় দেওয়া হবে না।

তিনি আরও বলেন, সাধারণ কেন্দ্রে বা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তা নির্বাচন কমিশন থেকে গাইডলাইন দেওয়া আছে। আমরা সেই গাইডলাইন ফলো করবো। তা ছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে যা প্রয়োজন আমরা সবই করবো, সেই প্রস্তুতি আমাদের আছে।

Place your advertisement here
Place your advertisement here