• রোববার ১৯ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

  • || ১০ জ্বিলকদ ১৪৪৫

Find us in facebook

দাম্পত্য কলহ সন্তানের মানসিক বিকাশে যেভাবে প্রভাব ফেলে

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  

Find us in facebook

Find us in facebook

প্রত্যেক বাবা-মার কাছে সন্তান এতোটাই মূল্যবান যার তুলনা অন্য কিছুর সঙ্গে হয় না। নিজের সন্তান যেন সুরক্ষিত থাকে, সুস্থ থাকে, ঠিকঠাকভাবে বেড়ে ওঠে, এটাই সব বাবা-মার চাওয়া।

সন্তানের সামান্য জ্বরেও বাবা-মা কী করবেন তা বুঝতে পারেন না, হাজার প্রচেষ্টা সন্তানের কষ্ট যদি একটু কমাতে পারেন! এই তো বাবা-মার অকৃত্রিম ভালোবাসা সন্তানের প্রতি। কথাগুলো সবারই জানা।

কিন্তু আজ সেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলবো যা আমরা অনেকেই অগ্রাহ্য করেই যাই। আর তা হলো দাম্পত্য কলহ ও সন্তানের মানসিক স্বাস্হ্য।

বাবা-মার পারস্পরিক আস্থা ও ভালোবাসার সম্পর্ক থেকেই শিশু প্রথম বুঝতে শেখে যে পরিবার আসলে কী। বাবা-মায়ের ভালোবাসা যেমন সন্তানকে সুস্থ, সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে; ঠিক তেমনি দাম্পত্য কলহ বা মনোমালিন্য সন্তানকে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর দিকে ঠেলে দেয়।

দাম্পত্য কলহ সন্তানের মানসিক বিকাশে যেভাবে প্রভাব ফেলে

পরিবারে যদি পারিবারিক সহিংসতার মতো ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে সেই পরিবেশে সন্তানের সুস্থভাবে বড় হওয়া কি সম্ভব? একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৭২% বিবাহিত নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। ২০১৩ সালে সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স জার্নাল তাদের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে যেখানে বলা হয়, ৬ মাস বয়সী বাচ্চার সামনেও যখন বাবা-মায়ের ঝগড়া বিবাদ হয়, তখন সেটা মস্তিষ্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। দীর্ঘদিন এই ধরনের চাপযুক্ত পরিবেশে থাকার ফলে মানসিক বিকাশও দেরিতে হয়।

এছাড়া আরো একটি প্রতিবেদনে এসেছে কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে টিনেজ পর্যন্ত যেসব ছেলে-মেয়ে পরিবারের দ্বন্দ্ব সংঘাতের মাঝে বড় হয়, প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় অনেক ক্ষেত্রে তাদের মানসিক ব্যাধি দেখা দেয়।

চলুন দেখে নিই এক্ষেত্রে সন্তানের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ে

আত্নবিশ্বাসের ঘাটতি: ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের কলহ দেখে বড় হলে সে কিন্তু আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারে না। যেহেতু সুস্থ পারিবারিক পরিবেশটা পাচ্ছে না এবং এই অবস্থায় তার কী করা উচিত, সেটাও বুঝে উঠতে পারে না। আস্তে আস্তে সে তার আত্নবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। নিজের ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগও সে পায় না।

কাজে অমনোযোগীতা: আত্নবিশ্বাস হারিয়ে ফেলার কারণে কোনো কাজেই সে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। এটাও এক ধরনের মানসিক ব্যাধি।

জেদ ও রাগ বেড়ে যাওয়া: একেক জন শিশুর মাঝে দেখা যায় একেক ধরনের পরিবর্তন। কেউ প্রচন্ড রকমের ভীতু, কেউ জেদি, কেউ বা রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, এই ধরনের ইস্যু দেখা যায়। সব সময় উদাসীন থাকা, কারো সঙ্গে মিশতে না চাওয়া বা খেলতে যেয়ে অন্যদের সঙ্গে অভদ্র কথা বলা – এসবই পারিবারিক অশান্তির ফলাফল। দাম্পত্য কলহ সন্তানের মানসিক বিকাশের প্রতিটা ধাপেই বাধা সৃষ্টি করে।

একাডেমিক কার্যক্রমে অবনতি: যে বাচ্চাটা সবসময়ই মন খারাপ করে থাকে, ঘরে ঝগড়া দেখে বড় হয়; তার জন্য লেখাপড়ায় মনোযোগ ধরে রাখা বেশ কঠিন। আর সে একটা সময় এসে হাল ছেড়ে দেয়। এজন্যই দেখা যায়, অনেক ছেলে মেয়ে টিনেজে এসে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে, ইয়ার ড্রপ দেয়। পড়াশুনাতে আর ফোকাসড থাকতে পারে না।

শারীরিক অসুস্থতা: একটানা মানসিক চাপে থাকতে থাকতে কিন্তু শরীরে বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি দেখা দেয়। ইনসমনিয়া, জ্বর, দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা, মাথা ব্যথা এমনকি অস্বাভাবিকভাবে কথা বলা, কথা জড়িয়ে যাওয়াসহ নানা রকমের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আর মানসিক অবসাদ তো তার নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে যায়।

প্রাপ্তবয়সে এসেও মেন্টাল ট্রমা: যদি শৈশব কাটে আতঙ্কে, নিরাপত্তাহীনতায়; তাহলে ভবিষ্যতে কী হবে ভাবুন তো? দাম্পত্য কলহ দেখে যারা বড় হয়, তারা জীবনে সঠিক লাইফ পার্টনার চুজ করতে কনফিউজড থাকে। এই মানসিক ট্রমার কারণে তারা বিবাহিত জীবনেও ইনসিকিউরিটিতে ভোগে। অনেকে অবশ্য ট্রাই করে বা স্ট্রাগল করে এই ট্রমা কাটিয়ে ওঠার।

তাহলে বাবা-মায়ের করণীয় কী?
(১) একবার নিজেকে প্রশ্ন করুন তো, আপনার রাগ, ইগো সবকিছু কি আপনার সন্তানের চেয়ে বড়? যেকোনো কথা কাটাকাটিতে জড়ানোর আগে একবার ভেবে নিন এতে কি আপনার কোনো উপকার আছে ক্ষতি ছাড়া? বা আপনি তর্কে জিতে খুব খুশি হচ্ছেন, এদিকে আপনার সন্তান ভয় পাচ্ছে, অসহায় বোধ করছে; তাহলে আপনার এই সাময়িক জিতে যাওয়াতে কার লাভ হলো?

(২) সবসময় চেষ্টা করবেন উত্তেজিত না হয়ে আস্তে কথা বলে সমস্যার সমাধান করতে। বাচ্চার সামনে কোনোভাবেই তর্কে জড়াবেন না। বরং ঐ জায়গা থেকে সরে যাওয়া, চিন্তা ভাবনা করে পরে কথা বলাই বেস্ট ডিসিশন। মনে রাখবেন, বাচ্চাকে যা শিখাবেন, সে তাই শিখবে। আপনি ভালো কথা, ভালো কাজ করলে বাচ্চাও তাই শিখবে। আপনি রুডলি কথাবার্তা বলতে থাকলে সে সেটাই মনে রাখবে।

(৩) সন্তানের পড়াশোনা থেকে শুরু করে সবকিছুর দায়িত্ব একজনের ওপর না দিয়ে দায়িত্ব বন্টন করুন। সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানো খুব জরুরি। তার মনের কথা, সে কী ভাবছে, কী জানাতে চাচ্ছে, সব কিছু খেলা বা গল্পের ছলে জেনে নিন। বাইরে ঘুরতে যাওয়া বা একসঙ্গে সময় কাটানো শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে সাহায্য করে।

(৪) পারিবারিক কলহকে কেন্দ্র করে বাচ্চাকে কখনোই যেকোনো একজনের পক্ষ নিতে বাধ্য করবেন না। বা তার কাছে একজন আরেকজনের খারাপ দিক তুলে ধরবেন না। সন্তানকে পজেটিভ থাকতে সাহায্য করুন। বাবা-মা সম্পর্ককে ইতিবাচক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করুন।

এর সমাধান কী তাহলে?
বাচ্চা নিলেই সংসারের সব সমস্যা মিটে যাবে, এটি ভুল ধারণা। দাম্পত্য কলহ না মিটিয়ে এবং নিজেদের পরিবর্তন না করে সংসারে সন্তানের আগমনে কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? বরং আপনার ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে না পারার কারণে আপনার সন্তান ট্রমার শিকার হবে প্রতিনিয়ত।

তাহলে কী করা উচিত? আলাদা হয়ে যাবেন? সন্তান সবসময়ই তার বাবা-মা দু’জনকেই পাশে পেতে চায়। তাই সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য নিজেরা কিছু ক্ষেত্রে কম্প্রোমাইজ করুন, মিউচুয়ালি ডিসিশন নিন, কমিউনিকেশন গ্যাপ থাকলে সেটা মিটিয়ে ফেলুন। প্রয়োজনে এক্সপার্ট হেল্প নিন, একজন কনসালট্যান্ট এর শরণাপন্ন হোন। কাপল কাউন্সেলিং একটি ভালো অপশন হতে পারে।

আর একান্তই যদি কম্প্রোমাইজ করা অসম্ভব হয়ে যায়, বাচ্চা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয় তাহলে সেক্ষেত্রে বুঝে শুনে আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, অবশ্যই দু’পক্ষের সম্মতিক্রমে। এতে করে অন্তত সন্তান প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনা থেকে রেহাই পাবে। সন্তান যেন স্বাভাবিক, সুস্থ পরিবেশে বড় হতে পারে, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

বাবা-মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সন্তানকে নিরাপত্তাবোধ দেয়। নিজেদের কিছু ভুলের জন্য আপনার সন্তানের সুন্দর শৈশব যেন ট্রমা না হয়ে যায়! স্বামী স্ত্রী একে অপরকে সম্মান করুন এবং সন্তানের নিরাপদ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করুন।

Place your advertisement here
Place your advertisement here