• বুধবার ০৮ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৫ ১৪৩১

  • || ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook

সেদিন যা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১৭ মে ২০২৩  

Find us in facebook

Find us in facebook

জাতির পিতাকে হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ ছয় বছর নির্বাসন জীবন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেই সাংগঠনিক ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ঐ দিন সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ আয়োজিত গণসংবর্ধনা সমাবেশে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা জনগণের কাছে তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচারও দাবি করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সময় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে ছিলেন। এরপর আর ছয় বছর তাদের দেশে ফিরতে দেওয়া হয়নি। সেদিন শেরেবাংলা নগরে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়। দিনটি ছিল রবিবার। কালবৈশাখীর ঝোড়ো হাওয়ার বেগ ছিল ঘণ্টায় ৬৫ মাইল। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি আর বৈরী আবহাওয়াও গতিরোধ করতে পারেনি গণতন্ত্রকামী লাখ লাখ মানুষের মিছিল। সারা দেশের গ্রাম-গঞ্জ-শহর-নগর-বন্দর থেকে অধিকারবঞ্চিত জনতা ছুটে এসেছিল রাজধানী ঢাকায়। গণতন্ত্রকামী লাখো কণ্ঠের স্লোগানে প্রকম্পিত পুরো রাজধানী। তাকে একনজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত জনসমুদ্র। গণসমুদ্রের প্রবল জোয়ারে ভাসিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, টানা তৃতীয় বারসহ চতুর্থ বারের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পিতা-মাতা-ভাইসহ পরিবারের সবাইকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৭ মে দেশে ফিরে এসে সমাবেশে আরো বলেন, ‘আপনাদের কাছে আমি বিচার চাই। দেশের বর্তমান দুর্বিষহ অবস্থার জন্য যারা দায়ী, জনগণের কাছে তাদের বিচার চাই। খুনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে যে সরকার, তারা জনগণের কল্যাণ করতে পারে না।’ তিনি জনগণকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা রূপায়ণের লক্ষ্যে সংগ্রাম সূচনার অঙ্গীকার করে বলেন, সেইদিন ১৯৭৫-এর হত্যার বিচার হবে, যেদিন বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়িত হবে, সেদিন শোষণমুক্ত সমাজ ও শোষণহীন গণতন্ত্র কায়েম হবে। তিনি সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আসুন আবার আমরা ঐক্যবদ্ধ হই।’

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর চরম এক প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয় বিদেশে থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে যাওয়া আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তবে বিদেশে থাকাকালেই ১৯৮১ সালের ১৬-১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে দলের নেতারা শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর নেতারা তার হাতে তুলে দেন তত্কালীন বহুধাবিভক্ত, পঁচাত্তর-পরবর্তী ষড়যন্ত্রে খণ্ডিত এবং দেশের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যের সাফল্যগাথা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পতাকা।

ঝড়-বাদল আর জনতার আনন্দাশ্রুতে অবগাহন করে শেরেবাংলা নগরে লাখ লাখ মানুষের সংবর্ধনা ও হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা-ভালোবাসার জবাবে বঙ্গবন্ধুর এই কন্যা আরো বলেছিলেন, ‘আমি সামান্য মেয়ে। সক্রিয় রাজনীতির দূরে থেকে আমি ঘর-সংসার করছিলাম। কিন্তু সবকিছু হারিয়ে আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। বাংলার দুঃখী মানুষের সেবায় আমি আমার এ জীবন দান করতে চাই। আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই। আপনাদের নিয়েই আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তা বাস্তবায়ন করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, বাঙালি জাতির আর্থসামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।’ তিনি বলেন, ‘স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালি জাতি রক্ত দিয়েছে। কিন্তু আজ স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। ওদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।’

দলীয় নেত্রীর আবেগময় কান্নার সময় তার বক্তৃতার আহ্বানের জবাবে আধা ঘণ্টাব্যাপী এই সমাবেশে শ্রোতারা মুহুর্মুহু স্লোগান দিতে থাকে। সভায় সভাপতিত্ব করেন আব্দুল মালেক উকিল। সভা;নেত্রীকে স্বাগত জানিয়ে বক্তৃতা করেন সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক। বক্তৃতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা বারবার অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘পঁচাত্তরে হত্যাকাণ্ডের জন্য সরকারের কাছে নয়, আপনাদের কাছে বিচার চাই।’ দল ও জনগণের কথা ভেবে স্বামী-পুত্রকে রেখে দেশে আসার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই ঢাকা শহরে আমার কেউ  নেই।’ বাংলার দুঃখী মানুষের জন্য পিতার জীবন দানের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘এই সংগ্রামে আমিও জীবন দান করতে প্রস্তুত।’ তিনি বলেন, ‘আমি নেতা নই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠার একজন কর্মী। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য আপনাদের নিয়ে আমি নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাব।’ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে অদ্যাবধি বিভিন্ন সংগ্রামের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে গত ছয় বছরে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতাম।’ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সময় দ্রব্যমূল্য কী ছিল আর আজ মূল্য কোথায় পৌঁছেছে, তা বিচার করবার দায়িত্ব জনগণের ওপর ছেড়ে দিয়ে তিনি বলেন, কৃষক কৃষি পণ্যের দাম পায় না, শ্রমিক নেতাদের ন্যায্য মজুরি পায় না, জনগণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, পথে ঘাটে মানুষ খুন হচ্ছে। সংবর্ধনা সভায় আব্দুল মালেক উকিল বলেন, এক মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে লক্ষ লক্ষ মুজিবের  জন্ম হয়েছে।

এদিকে বিকাল সাড়ে ৪টায় আকাশে যখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী ফ্লাইটটি দেখা যায়, তখন সব নিয়ন্ত্রণ আর অনুরোধ আবেদন অগ্রাহ্য করে হাজার হাজার মানুষ বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকে যায়। অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই ফ্লাইটটি অবতরণ করে। জনতা একেবারেই বিমানের কাছে চলে যায়। বহু চেষ্টার পর জনতার স্রোতকে কিছুটা সরিয়ে ট্রাকটি ককপিটের দরজার একেবারে সামনে নেওয়া হয়। এ সময় শেখ হাসিনা ভেতর থেকে জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন। বেলা ৪টা ৩২ মিনিটে শেখ হাসিনা সিঁড়ি দিয়ে ট্রাকে নেমে আসেন। এ সময় লাখো জনতার কণ্ঠে ছিল গগণবিদারী স্লোগান :‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম—মুজিব হত্যার বদলা নেব’, ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে—আমরা আছি তোমার সাথে’, ‘শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’। এ সময় অনেকের চোখে ছিল অশ্রুধারা। যখন তাকে মালা পরিয়ে দেওয়া হয়, তখন শেখ হাসিনাও অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন। এ সময় শেখ হাসিনার পরনে ছিল সাদা রঙের ওপর কালো ডোরাকাটা তাঁতের মোটা শাড়ি ও মাথায় ঘোমটা। কুর্মিটোলা থেকে শেখ হাসিনার শেরেবাংলা নগরে এসে পৌঁছতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। এ সময় ঝড়বৃষ্টিতে নগরজীবন প্রায় বিপন্ন। রাস্তাঘাট স্বাভাবিক জীবন যখন ব্যাহত, তখন এখানে অপেক্ষা করে কয়েক লাখ মানুষ। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় তিনি গণসংবর্ধনা মঞ্চে উপস্থিত হন। এ সময় স্বাধীনতার অমর স্লোগান, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় গোটা এলাকা।

শেখ হাসিনা সেদিন যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তা বাস্তবায়নে তিনি আজও নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। ৪২ বছর ধরে গভীর ষড়যন্ত্র, বারবার প্রাণনাশের চেষ্টা, গ্রেফতার-নির্যাতনসহ শত-সহস্র বাধা অতিক্রম করে জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে দেশে ফেরার ১৫ বছরের মাথায় আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিতে সক্ষম হন শেখ হাসিনা। পাঁচ বছর দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সরকার পরিচালনা করে দেশকে নিয়ে যান উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে। এরপর আবার ষড়যন্ত্র। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পাঁচ বছরের বিভীষিকাময় নির্যাতনে নেতাকর্মীরা যখন দিশেহারা, তাকেসহ পুরো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করতে গ্রেনেড হামলার মুখেও অবিচল থেকে দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখে বন্ধুর পথ পাড়ি দেন বঙ্গবন্ধুর এই কন্যা। এরপর ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সামরিক নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত, দীর্ঘদিন কারাবাসে থেকেও কোনো অপশক্তির কাছে মাথা নত করেননি শেখ হাসিনা। ঐ সময় ভয়ভীতি ও ষড়যন্ত্রে অনেক নেতা পথভ্রষ্ট হওয়ার উপক্রম হলেও জেলে থেকেও সফল দিকনির্দেশনা দিয়ে আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের অটুট বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সক্ষম হন তিনি। শেখ হাসিনার এই অবিচল ও সাহসী নেতৃত্ব আর জনগণের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের কারণেই ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে দেশের জনগণ ইতিহাসের সর্ববৃহত্ তিন-চতুর্থাংশ আসনে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে প্রধানমন্ত্রী করেন শেখ হাসিনাকে।

Place your advertisement here
Place your advertisement here