• রোববার ১৯ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

  • || ১০ জ্বিলকদ ১৪৪৫

Find us in facebook

‘বিগ বি ও বদলে যাওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতি’

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১২ মে ২০২৩  

Find us in facebook

Find us in facebook

জাপানের দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (বিগ-বি) প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ অনন্য উচ্চতায় যাবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিতে বেশ কয়েক বছর আগে এ প্রস্তাবটি দেশটির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল। বিগ-বি বাস্তবায়ন হলে দেশের শিল্প ও বাণিজ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং পরিবহন ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। বাড়বে জাপানি বিনিয়োগ এবং বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানিও। সমুদ্র দৃষ্টিকোণ থেকে বঙ্গোপসাগর এবং দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যবর্তী স্থলভূমি থেকে অভ্যন্তরীণভাবে বাংলাদেশ অবস্থিত। ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগর অঞ্চলের দিকে বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি পরিবর্তনের অধীনে, এ ভৌগোলিক সুবিধাটি দেশকে আঞ্চলিক পাশাপাশি আন্তঃআঞ্চলিক বিষয়গুলোতে নোড এবং হাবের ভূমিকা পালনের একটি অনন্য সুযোগ প্রদান করবে। এটি প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগরে স্পন্দিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে কাজে লাগাতে ‘লুক ইস্ট’ নীতিতে বাংলাদেশের নবনিযুক্ত ফোকাসেরও পরামর্শ দেয়। বিআইজি-বি উদ্যোগটি ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বেল্ট অঞ্চল এবং এর বাইরেও শিল্পোদ্যোগকে ত্বরান্বিত করা, উন্নয়নশীল অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে অন্তর্ভুক্ত করা, বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করা এবং সংযোগ বাড়ানো। 

 ২০১৪ সালের মে মাসে জাপানের টোকিওতে শীর্ষ বৈঠকের সময় সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান-বাংলাদেশ ব্যাপক অংশীদারিত্বের ধারণায় দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও জোরদারে সম্মত হন। সে বৈঠকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ৪-৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রস্তাবের ঘোষণা দেয়। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ সফর করেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। তখনই দুদেশ বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট অর্থাৎ বিগ-বি উদ্যোগের অধীনে অংশীদারিত্বের ধারণায় সম্মত হন। উভয় প্রধানমন্ত্রী উভয় দেশের পারস্পরিক সুবিধা এবং সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য জাপানের উন্নত প্রযুক্তি এবং আর্থ-সামাজিক বিকাশের অভিজ্ঞতার সর্বাধিক ব্যবহার সহ এই উদ্যোগের প্রত্যাশা করেছিলেন।বিআইজি-বি বাংলাদেশকে তার জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে আঞ্চলিক অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে এবং দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া উভয়কে ঘনিষ্ঠ আন্ত-আঞ্চলিক সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একটি প্রবেশদ্বার সরবরাহের পূর্বাভাস দিয়েছে, যাতে সে নিজেকে একটি চমকপ্রদ বাণিজ্য হিসাবে রূপ দিতে পারে। আন্তঃদেশীয় এবং বৈশ্বিক মান চেইনে জাতি গভীরভাবে সংহত হয়েছে। বিআইজি-বি আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য অন্যান্য বিদ্যমান গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোর সাথে বেমানান নয়। বরং এটি বাংলাদেশের সুবিধার সর্বাধিকতরকরণের জন্য তাদের পরিপূরক ও পুনর্বহাল করা।

বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দার মধ্যে গত দশকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে গড়ে ৬% প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, এবং ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। করোনা মহামারির অভিঘাতের আর্থিক ক্ষতি মোকাবিলা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং স্বল্পোন্নত বা এলডিসি উত্তরণে এবার বিগ-বি বাস্তবায়নে সরকার সর্বোচ্চ জোর দিচ্ছে। এরই মধ্যে জাপানের সহায়তায় ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে চালু হয়েছে মেট্রোরেল। গত ডিসেম্বরে মেট্রোরেলের একাংশ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে । জাপানের ‘বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’ বা বিগ-বি ধারণায় বদলে যাচ্ছে মহেশখালী ও সেখানে গড়ে উঠছে গভীর সমুদ্রবন্দর ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। চলমান প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে শুধু মাতারবাড়িই বদলাবে না, এই মাতারবাড়িকে কেন্দ্র করে বদলে যাবে দেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ক্রমেই বড় হচ্ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমদানি-রপ্তানি। ব্যস্ততম চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ সম্পাদিত হলেও এ বন্দরের জাহাজগুলোকে ব্যবহার করতে হয় অন্য দেশের ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট। কারণ বড় জাহাজগুলো চট্টগ্রামে ভিড়তে পারে না। মাতারবাড়িতে হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর, যেখানে ভিড়তে পারবে ১৬-১৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজ। অর্থাৎ সবচেয়ে বড় জাহাজটিও নোঙর করতে সক্ষম হবে এ বন্দরে। 

শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ নিজেই হবে একটি ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টের মালিক। এতদিন বাংলাদেশ ব্যবহার করেছে অন্য দেশের বন্দর। আর মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর হবে রিজিওনাল পোর্ট, যা সেবা দিতে পারবে আশপাশের দেশগুলোকে। গভীর সমুদ্রবন্দর ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন। প্রকল্পগুলো শেষ ও  চালু হলে মাতারবাড়ি হবে রিজিওনাল হাব। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগ আসবে। গত বছরে ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিয়োগের প্রস্তাব পেয়েছে বিডা। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারে জাপানি অর্থায়নে গড়ে উঠছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। সেখানেও জাপানের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারবেন। তবে দেশে জাপানি বিনিয়োগ বাড়লেও দেশটিতে বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানি বাজার এখনো সম্প্রসারণ করতে পারেনি। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পেলেও জাপানে হয়নি। বলা হচ্ছে- এফটিএ করা গেলে জাপানেও বাংলাদেশি পণ্যের বড় বাজার তৈরি হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আর বিগ-বি উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা গেলে বঙ্গোপসাগর কেন্দ্র করে জাপান বড় ধরনের শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে চায়। তেমনটি হলে জাপানের সরকারি-বেসরকারি খাত বড় বড় বিনিয়োগ নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছে।

২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হবে। এ কারণে ওই সময়ের পরও ব্যবসা-বাণিজ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা বজায় রাখতে জাপানের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের প্রথম পদক্ষেপ এটি।  রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, জাপানই এশিয়ার একমাত্র দেশ যেখানে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ থেকে জাপানে পোশাক সামগ্রীর চালান এপ্রিল ২০১১ থেকে শুরু হয়, যখন দেশটি স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য এবং নিটওয়্যার খাতের জন্য তার শুল্কনীতি শিথিল করে।বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, জাপানের সঙ্গে এফটিএ করার ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। না হলে বাংলাদেশ থেকে ২০ শতাংশ জাপানি বিনিয়োগ অন্য দেশে চলে যেতে পারে বলে উঠে এসেছে এক জরিপে। জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) ও জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (জেবিসিসিআই) পরিচালিত সমীক্ষার এ ফল সম্প্রতি ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করা হয়। এতে ১০০ জাপানি ও ৩০ বাংলাদেশি বহুজাতিক কোম্পানি ওই জরিপে অংশ নেয়। অনুষ্ঠানে জেট্রোর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ বলেন, জরিপের অংশগ্রহণকারী ৮৫ শতাংশ অর্থাৎ ১১১ কোম্পানি আশা করছে- জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে এফটিএ সই হবে। আবার ২০ শতাংশ জাপানি কোম্পানি বলেছে- এলডিসি থেকে উত্তরণের পর জাপানে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) উঠে গেলে তারা বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক বাজার চীন ও ভারতের মতো দেশে স্থানান্তরিত করার চিন্তা করতে পারে। অথবা কমিয়ে দিতে পারে উৎপাদন। ওই সময় ঢাকার জাপান দূতাবাসের পক্ষ থেকে বলা হয়, এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ হলে এখনকার জিএসপি সুবিধা থাকবে না। সেক্ষেত্রে নতুন ব্যবস্থাপনা দরকার, যা এফটিএ হতে পারে।এলডিসি উত্তরণের পর জাপানের বাজারে বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখতে তিনটি সুপারিশ করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সেগুলো হলো-জিএসপি পাস নিয়ে দর-কষাকষি, কোভিড প্রেক্ষাপটে আরও দু-তিন বছর বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখা ও এফটিএ সই। এছাড়া জাপানের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে দেশের ভেতরে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করার তাগিদ দেওয়া হয়। জাপান বরাবর বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনের পরই বঙ্গবন্ধু জাপান সফর করেছিলেন। রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় হওয়া, উদ্যোক্ততাশূন্য বাংলাদেশে এখন লাখো উদ্যোক্তা তৈরি হওয়াসহ সামগ্রিক আমদানি ও রপ্তানিতে দেশ এগিয়ে গেছে। এক সময়কার আমদানিনির্ভর বাংলাদেশ এখন আমদানি বিকল্প পণ্যের শিল্প-কারখানা গড়ে তুলেছে। খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বের প্রথমসারির দেশগুলোর কাতারে দেশের নাম লিখিয়েছেন কৃষকরা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) হার ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৩২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার ও রফতানির পরিমাণ ৩৮ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৬১০ ডলার। এ সময়ে মুদ্রাস্ফীতি বিগত ৫৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন ডিসেম্বরে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। দারিদ্র্য হার ৫৭ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি সম্প্রসারণ ও তাতে অর্থ সহায়তা বৃদ্ধি করায় ৫৭ লাখ ৬৭ হাজার মানুষের দারিদ্র্য থেকে মুক্তিলাভ সহজ হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এ বদলাতে থাকা অর্থনীতি আরও আমূল-পরিবর্তন নিয়ে আসবে। বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট বা বিগ বি ধারণার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে নবদিগন্তের সূচনা হয়েছে সেটা বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশনেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতায় আরও অনেক এগিয়ে যাবে এবং সুন্দর পরিবর্তন আসবে।

লেখক: অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া, ট্রেজারার বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Place your advertisement here
Place your advertisement here