• বুধবার ০১ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৮ ১৪৩১

  • || ২১ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook

পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সুইডিশ বিচারপতি সমাধিস্থ হতে চান বাংলাদেশে

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১২ ডিসেম্বর ২০২২  

Find us in facebook

Find us in facebook

পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সুইডিশ বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার শেষ ইচ্ছা জানিয়ে চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে তিনি লেখেন, মৃত্যুর পর তিনি বাংলাদেশে সমাধিস্থ হতে চান। মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত এই বিচারপতি ও কবির অন্তিম ইচ্ছার কথা এক প্রতিবেদনে জানায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস।

বাসসের সঙ্গে টেলিফোন আলাপে বিচারপতি সৈয়দ আসিফ বলেন, ‘আমার বয়স ৭২ বছর। আমি জানি না, আমি আর কত দিন বাঁচবো। কিন্তু বাংলাদেশের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আমি বাংলাদেশের মাটিতেই সমাধিস্থ হতে চাই। বাংলাদেশের নাগরিক না হলে যেহেতু সেখানে সমাধিস্থ হতে পারবো না, তাই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চেয়ে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি চিঠি লিখেছি।’

প্রতিবেদনে জানানো হয়, সৈয়দ আসিফ শাহকার পাকিস্তানের পাঞ্জাবের হরোপ্পায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ২২ বছরের তরুণ। পাঞ্জাব স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২৫ মার্চের কালরাতে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের নির্মম ও নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিকদের একটি অংশ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তাদের সঙ্গে প্রতিবাদ, সমাবেশ, কবিতা লেখা ও লিফলেট বিতরণ করেন এই তরুণ। পরিণামে তিনি ঘৃণার পাত্র হয়ে ওঠেন নিজ পরিবার, সমাজ ও দেশের মানুষের কাছে। তাকে ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি পাকিস্তানের কারাগারে মানসিক-শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। তবু তিনি বাংলাদেশের বিপক্ষে যাননি। শেষে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পর সৈয়দ আসিফ বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান।

সৈয়দ আসিফ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের বিজয় না হলে আমিও কারাগার থেকে মুক্ত হতে পারতাম না। আমাকে পাকিস্তানের কারাগারেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো অথবা কারাগারেই জীবন পার হয়ে যেত।’

জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি কিছুদিন লাহোরে পাকিস্তান টেলিভিশনে প্রযোজক হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু নিজ দেশে ‘কুলাঙ্গার’ হিসেবে স্থায়ী পরিচিতি নিয়ে তিনি বেশি দিন পাকিস্তানে থাকতে পারেননি। ১৯৭৭ সালে রাজনৈতিক আশ্রয়ে যান সুইডেনে। শুরু করেন নতুন এক জীবনযুদ্ধ। পরে তিনি সুইডেনের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান এবং কর্মজীবন শুরু করেন।

স্বাধীনতার ৪১ বছর পর ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে বিচারপতি আসিফ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশে আসেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালের ১৫ ডিসেম্বর তার হাতে এই সম্মাননা তুলে দেন। সৈয়দ আসিফ নিজেকে পাকিস্তানের নাগরিক নয়, বরং বাংলাদেশের নাগরিক ভাবতে ভালোবাসেন। তাই তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানিয়েছেন। যাতে তার মৃত্যুর পর তাকে বাংলাদেশের মাটিতে সমাধিস্থ করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ইংরেজিতে লেখা ৭৬৭ শব্দের চিঠিতে তিনি বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তার ভালোবাসার কথা জানিয়েছেন। পাশাপাশি এ দেশের মাটিতে শায়িত হওয়ার আকুল বাসনা ব্যক্ত করেছেন।

চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রতি আমার ভালোবাসা হয়তো আমি সারাজীবনেও ভাষায় প্রকাশ করে শেষ করতে পারবো না। আমি যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, তখন আমাকে যে ভালোবাসা, সম্মান ও শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে, তাতে আমি প্রচণ্ড বিহ্বল ও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। যখন বাংলাদেশ থেকে সুইডেনে রওনা হবো, তখন অনুভব করছিলাম যে আমার চলে যাওয়া হবে এক প্রাণহীন প্রস্থান এবং পেছনে রয়ে যাবে আমার আত্মা।’

তিনি বলেছেন, ‘সুইডেনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এক বৈঠকে আমি ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম যে আমি বাংলাদেশের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাধিস্থ হতে চাই। তিনি আমার আকুলতা ও বিষাদ দেখে দ্রুত উত্তর দিয়েছিলেন, ‘সেটা সম্ভব নয়’। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন? আপনি আমার জন্য কয়েক গজ জায়গা ফাঁকা করতে পারবেন না?’ তিনি বললেন, ‘না, কারণ আপনি বাংলাদেশের নাগরিক নন।’

বিচারপতি আসিফ বলেন, ‘বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী তিনি (রাষ্ট্রদূত) হয়তো ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, আমি যেন আকাশ থেকে মাটিতে পতিত হলাম। তার উত্তর আমাকে হতবাক করে দিয়েছিল এবং আমার মনে হয়েছিল, তিনি যেন ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড’টি আমার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছেন, যা ২০১২ সালে বাংলাদেশ আমাকে দিয়েছিল। আমার কাছে সেই পুরস্কারটি কেবল একটি পুরস্কার ছিল না, এর মধ্যে দিয়ে আমি মুক্ত হয়েছি এবং আমার দীর্ঘ হারানো পরিচয় খুঁজে পেয়েছি।’

সুইডেনের স্টকহোমে বসবাসরত অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকার বাংলাদেশের জন্য আজও কাজ করে যাচ্ছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের ওপর যে নৃশংস গণহত্যা পরিচালনা করেছে, তার বিচারের দাবিতেও তিনি ছিলেন সোচ্চার। স্বাধীনতার ৫১ বছর পার হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর আর কোনও দেশে এত বড় গণহত্যা সংঘটিত হয়নি। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের গণহত্যাকে জাতিসংঘ আজও স্বীকৃতি দেয়নি।

গত ৩ অক্টোবর জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সদর দফতরে জাতিসংঘের স্বীকৃতি আদায়ের দাবিতে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরামের সহায়তায় নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক প্রবাসী সংগঠন বাংলাদেশ সাপোর্ট গ্রুপ, আমরা একাত্তর ও প্রজন্ম ৭১ আয়োজিত এ আলোচনা সভায় সৈয়দ আসিফ শাহকার আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য এবং হত্যাকারীদের বিচারের জন্য জাতিসংঘের প্রতি জোরালো আবেদন জানান।

চিঠিতে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, ‘‘আমার মনে পড়ে আপনার সেই বক্তৃতা, যেখানে আপনি বলেছিলেন, ‘যে বিদেশি স্বাধীনতাযুদ্ধে সমর্থন করেছিল, সেও একজন মুক্তিযোদ্ধা।’ আপনার কথা আমাকে এই হতাশা থেকে বেরিয়ে আসতে এবং সরাসরি আপনার দরজায় কড়া নাড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে। ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ সম্মাননা পেয়ে আমরা গর্বিত। বাংলাদেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা যখন বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারেন, এখানে থাকতে পারেন, একটি বাড়ির মালিক হতে পারেন, তখন মুক্তিযুদ্ধে সমর্থনকারী বিদেশি হয়েও কেন মৃত্যুবরণকারী বাংলাদেশের অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার মতো আমাকে এখানে দাফন করা যাবে না? আমি কেন বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারবো না? একজন বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধার মতো ঢাকায় আমার নিজের বাড়ি কেন নেই?’

সৈয়দ আসিফ বাংলাদেশের বিদেশি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ও বাংলাদেশে তাকে সমাধিস্থ করাসহ একজন নাগরিকের সুযোগ-সুবিধার আবেদন জানান এবং আমৃত্যু বাংলাদেশের জন্য কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসিফ শাহকার লিখেছেন, ‘আমি শুধু বিশ্বাস করি না, আমি নিশ্চিত যে আপনি আমার বিনীত অনুরোধটি আন্তরিকভাবে বিবেচনা করবেন।’

Place your advertisement here
Place your advertisement here