• বুধবার ১৫ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ১ ১৪৩১

  • || ০৬ জ্বিলকদ ১৪৪৫

Find us in facebook

হারিয়ে যাচ্ছে বহুমাত্রিক ফসল ঢেমশি

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৭ মার্চ ২০২৪  

Find us in facebook

Find us in facebook

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে দানাদার ফসল ঢেমশি। ত্রিশ বছর আগেও এই অঞ্চলে আবাদ হতো ঢেমশি। দরিদ্র শ্রেণির মানুষের নিত্যদিন ভাতের বদলে খাবার ছিল এই ঢেমশি। কিন্তু কৃষির অভূতপূর্ব উন্নয়নে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামীণ অঞ্চলে আবাদ হওয়া এ ফসলটি।

ঢেমশির মতো হারিয়ে যেতে বসেছে মারুয়া ও কাউন। তবে কাউনের কিছু আবাদ দেখা মিললেও মারুয়ার আবাদ নেই বললেই চলে। এতে করে বিলুপ্তির পথে এ ফসলটি।

বলা হয় পৃথিবীর ৫টি সেরা খাদ্যের মধ্যে ঢেমশি অন্যতম একটি। এটি একটি বহুমাত্রিক ফসল। ঢেমশি সরিষার মতোই শীতকালীন একটি ফসল। যার ইংরেজি নাম বাকহুইট। ফসলটি ৬০ দশক থেকে ৯০ দশক পর্যন্ত উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন জেলায় ব্যাপকভাবেই আবাদ হতো। কৃষিতে উচ্চমূল্যের ফসল, খাদ্যাভাসের পরিবর্তন ও বর্তমান ফসল সাথে ফসলটির আবাদে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে এ আবাদটি।

দেবীগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানায়, ঢেমশি আবাদ বিলুপ্তির পথে। তবে দেবীগঞ্জ উপজেলায় প্রায় দেড় হেক্টর জমিতে ঢেমশি আবাদ হচ্ছে। এর মধ্যে দেবীডুবার চেপ্টিকুড়া এলাকার চান মিয়া ১ হেক্টর (৭.৪৭ বিঘা) ও একই ইউনিয়নের স্কুলপাড়ার কৃষক শাহজাহান আলী ২ বিঘা জমিতে ঢেমশি আবাদ করছেন। ঢেমশি একটি স্বল্প জীবনকালের বিশেষ ফসল। সাধারণত উঁচু জমিতে সাথী ফসল হিসেবে ঢেমশি আবাদ করা যায়। এটি আবাদে রাসায়নিক সার দরকার হয় না। পোকামাকড় খুব একটা আক্রমণ না করায় তেমন বালাইনাশক ওষুধের প্রয়োজন পড়ে না। নিজেই আগাছা নষ্ট করে বলে আলাদা করে আগাছা দমন করতে হয় না ঢেমশির জন্য।

কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে বীজ বপন করে জৈবসার ব্যবহার করলে ফলন ভালো হয়। প্রতি একর জমিতে চাষের জন্য ১২ কেজি বীজের দরকার হয়। এক একর জমিতে এক মেট্রিক টন পর্যন্ত ঢেমসি উৎপাদন হতে পারে। আবার একই সময় ঢেমশির ফুল থেকে মধু উৎপাদন সম্ভব। ঢেমশি জমির একরে প্রায় ১২০ কেজি পর্যন্ত মধু পাওয়া যায়। অপরদিকে ঢেমশি ফুল আসার আগে এটি পুষ্টিকর শাক হিসেবে খাওয়া যায়। এ ফসলটিতে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি থাকলেও এদেশে খাদ্যের ক্ষেত্রে পুষ্টির বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। ফলে ঢেমশির মতো ফসলের দিকেও কর্তৃপক্ষের আগ্রহ কম থাকায় হারিয়ে যাচ্ছে ফসলটি।

দেবীগঞ্জের দেবীডুবা ইউনিয়নের স্কুলপাড়ার কৃষক শাহজাহান আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি প্রায় ২ বিঘা জমিতে ঢেমশি আবাদ করেছি। এ ফসল আবাদে তেমন খরচ নেই। লাভই বেশি। আমার আবাদ করা জমিতে ৫/৬ মণ ঢেমশি পাব বলে আশা করছি। বর্তমান বাজারে প্রতি মণ ঢেমশির দর রয়েছে ৪ হাজার টাকা। স্থানীয় বাজারে তেমন বেঁচা হয় না। এসব চলে যায় কুষ্টিয়ায়।

শাহজাহানের মতো লাল মিয়া ও জহির আলী নামের চাষিরা এই ঢেমশি আবাদ করছে। তারাও লাভবান হবেন বলে আশা করছেন।

দেবীগঞ্জ ছাড়াও এক সময় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার দর্জিপাড়া, কানকাটা, শারিয়াজোত, কাজীবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় আবাদ হতো এই ঢেমশির। গত ২৫-৩০ বছর আগেও উত্তরাঞ্চলে দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত মানুষগুলো ঢেমশি আটার রুটি ও পিঠা খেয়ে দিনযাপন করতে দেখা গিয়েছিল।

ঢেমশির পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানা যায়, প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি রয়েছে ঢেমশিতে। এতে রয়েছে ৩৪৩ কিলোক্যালরি শক্তি, ৫৫ শতাংশ শর্করা, ২৪ শতাংশ আমিষ, ১৭ শতাংশ টোটাল ফ্যাট, কোলস্টেরল ০ মিলিগ্রাম, ২৬ শতাংশ ডায়টেরি ফাইবার, সোডিয়াম ১ গ্রাম, পটাসিয়াম ৪৬০ মিলিগ্রাম (১০ শতাংশ), ক্যালসিয়াম ১৮ মিলিগ্রাম (২ শতাংশ), কপার ১.১, লৌহ ২.২০ (২৭.৫ শতাংশ) ম্যাঙ্গানিজ ১.৩, ফসফরাস ৩৪৭ মিলিগ্রাম ও দস্তা ২.৪ মিলিগ্রাম (২২ শতাংশ)। 

এছাড়া ঢেমসির চাল ও আটায় অতিমাত্রায় প্রোটিন, মিনারেল এবং ফাইবার রয়েছে। এতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, জিংক, ভিটামিন (বি১, বি২, বি৩, বি৬, বি১২) ও সেলেনিয়ামসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর উপাদান। 

ঢেমশিতে প্রাকৃতিকভাবে বেশি পরিমাণ আমিষ, ক্যালসিয়াম, জিংকসহ নানা উপাদান আছে বলে শিশু স্বাস্থ্যের জন্য দারুণ উপকারী। মূলত ভাত, মাছ, রুটি, দুধ, ডিম, সবজি ও ফলের প্রায় সব পুষ্টি উপাদান থাকার পাশাপাশি ঢেমশিতে আছে ভিটামিন, খনিজ, অ্যামাইনো এসিড ও ইলেকট্রলাইটস। দেহের হাড় ক্ষয় রোধ করে। ঢেমশির চাল বা আটা খেলে ডায়াবেটিক, ব্লাড প্রেসার, অ্যাজমা, হার্টের রোগের ঝুঁকি কমে বা নিরাময় হয়। বিভিন্ন প্রকার ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। ঢেমশি শিশুর হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে সহায়তা করে। এর আঁশ কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে ভূমিকা রাখতে পারে। 

জানা যায়, চীন, জাপান, আমেরিকা, রাশিয়া, ইউক্রেন, কাজাখস্তান, ব্রাজিল, বেলারুশ, ফ্রান্স, লিথুয়ানিয়া, তানজানিয়া, লাটভিয়া, ভুটান, কোরিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, বসনিয়া হার্জেগোবিনা, পোল্যান্ড, কানাডা ও কোরিয়ার মতো দেশে উল্লেখযোগ্য হারে এই ঢেমশির আবাদ হচ্ছে। এসব দেশে ঢেমসির বেশি কদর।

দেবীগঞ্জ উপজেলার কৃষি অফিসার নাঈম মোরশেদ বলেন, দেবীগঞ্জ উপজেলায় এ বছর দেড় হেক্টর জমিতে ঢেমশি চাষ হয়েছে। ফসলটি বিলুপ্তির পথে। তবে আমরা চেষ্টা করছি ঢেমশি চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে সব ধরণের সহায়তা করতে। এজন্য বিনামূল্যে বীজ, সার দেওয়ার পাশাপাশি কৃষি উপকরণসহ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।

Place your advertisement here
Place your advertisement here