• বুধবার ১৫ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ১ ১৪৩১

  • || ০৬ জ্বিলকদ ১৪৪৫

Find us in facebook

দারিদ্র্যের কবল থেকে যেভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন হেমা

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৮ অক্টোবর ২০২২  

Find us in facebook

Find us in facebook

‘আগে কোনও কিছুই বুঝতাম না। এখন টাকা গুনতে পারি, ফোন চালাতে পারি, ব্যবসা বুঝি। এখন আমাকে কেউ ঠকাতে পারে না। আগে আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছিল না, কিন্তু এখন আছে। এই আত্মবিশ্বাস আমাকে নিজের একটা পাকা বাড়ি করার স্বপ্ন দেখায়।’ কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাটেশ্বরী বাজারের পাশে ভোগডাঙ্গা গ্রামের হেমা খাতুন। জন্মের পর থেকেই তিনি একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। করোনা তার সংসারের আয় বন্ধ করে দিলেও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে তিনি করোনা পরবর্তী সময়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।

ব্র্যাকের সবচেয়ে বড় কর্মসূচি হলো আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন (ইউপিজি)। বাংলাদেশে অতি-দরিদ্রদের জন্য এই কর্মসূচি আগে টার্গেটিং দ্য আলট্রা-পুওর (টিইউপি) প্রোগ্রাম নামে পরিচিত ছিল। এই কর্মসূচি বিশ্বব্যাপী গ্র্যাজুয়েশন পদ্ধতির পথপ্রদর্শক হিসেবে স্বীকৃত। অতি-দারিদ্র্যের উদ্ভাবনী ও সামগ্রিক সমাধান পদ্ধতি হিসেবেও প্রশংসিত এটি।

এই গ্র্যাজুয়েশন পদ্ধতি বলতে বোঝাচ্ছে একটি বিস্তৃত, সময়সীমাবদ্ধ, সমন্বিত ও ধারাবাহিক কর্মসূচিকে। এর লক্ষ্য অতি-দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী পরিবারগুলোকে টেকসই জীবিকা এবং আর্থসামাজিক স্থিতিস্থাপকতার দিকে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জন করতে সক্ষম করা। যাতে চরম দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার পথ ধরে তারা অগ্রসর হন। পাইলট প্রকল্প হিসেবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম চলছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের চারটি জেলায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে দারিদ্র্যের গ্যাঁড়াকল থেকে বের করে নিয়ে আসা। চারটি জেলায় (রংপুর, কুড়িগ্রাম, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ) এক হাজার ২০০ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছেন, তাদের এর আওতায় এনে এই কাজ চলছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ন্যাশনাল সার্ভে অন পারসনস উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজ (এনএসপিডি) শীর্ষক প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮০ শতাংশ মানুষ শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী। এই প্রতিবন্ধী মানুষদের মধ্যে নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা বেশি।

২০১১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৯৮ লাখ। কিন্তু বিবিএসের তথ্য মতে প্রতি ১০ বছরে জনসংখ্যা গড়ে দুই কোটি বাড়ে। সেই বিবেচনায় দেশে বর্তমানে জনসংখ্যা ১৭ কোটির কম বা বেশি হবে। এই জনসংখ্যা হিসাব করলে দেশে এখন প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ৪৮ লাখের মতো।

ব্র্যাক জানাচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রগতি অর্জন করলেও অধিকাংশ প্রতিবন্ধী মানুষের অবস্থার উন্নতি হয়নি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা উচ্চ দারিদ্র্য ও বেকারত্বের শিকার। ব্র্যাক মনে করে, হেমার মতো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিশেষ চাহিদা আছে। দারিদ্র্যের কারণে তারা দ্বিগুণ বোঝাও অনুভব করেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কম আয়, চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা কম এবং সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। বাংলাদেশে সরকার ও নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিবন্ধীদের বিভিন্নভাবে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে প্রশ্ন তুলে আসছে।

হেমা জানান, ছোটবেলা থেকেই নানা রকম বঞ্চনার মধ্য দিয়ে আসছে হচ্ছে তাকে। আগের অবস্থার বর্ণনা দিতে গেলেও তিনি ডুকরে কেঁদে ওঠেন। হেমার স্বামী বাদামের ব্যবসা করতেন। করোনার কারণে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে সংসার চালানো খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে। প্রতিবন্ধিতা ও দারিদ্র্য দুই মিলে নিজের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেন। হেমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বাবা দিনমজুরের কাজ করতেন। অনেক কষ্টে আমাকে বড় করেছেন। আমার মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে ভাইকে লেখাপড়া করাইতেন। আমাকে চাপ দিয়ে বিয়ে করাইসে। বিয়ের পর স্বামী বাদামের ব্যবসা শুরু করে। সেই ব্যবসার টাকা ধার করসিলাম। করোনাভাইরাস আমার সব শেষ করে দিসে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ব্র্যাক আমার কাছে আসলো। আমার নাম নিলো। ব্র্যাকের কর্মীরা আমাকে জানালেন যে কিছু সম্পদ দেওয়া হবে।  কীভাবে কী করবেন? আমি বললাম, আমার স্বামী বাদামের ব্যবসা ভালো করতে পারে। কিছু টাকা পাইলে সেটাই করতাম। তার পাশাপাশি ছাগল থাকলে আরও ভালো হইতো। আমাকে তারা ১৮ হাজার টাকা দিলো বাদাম কেনার জন্য। আর চার হাজার টাকা দিয়ে একটা ছাগল কিনে দিলো। আমার স্বামী ব্যবসা শুরু করলো।’

তিনি বলেন, ‘আমি আগে টাকা চিনতাম না। দিক চিনতাম না। ব্র্যাকের আপা আমাকে টাকা চেনাইলো। আরেক ভাই পথ চেনাইলো। আরেক ভাই আমার খোঁজ-খবর রাখে। টাকা কীভাবে রাখি, ব্যবসা কীভাবে চলে এসব খোঁজ-খবর নেন। আমি বাদাম ব্যবসার কাজও এখন শেয়ার করি। আমি বাদাম ভেজে দেই, বাদাম প্যাকেট করে দেই। আমার স্বামী টাকা নিয়ে আসে, আমি গুনে নেই টাকা। আমার স্বামী যখন বাদাম কিনতে যায়, আমি বাদামওয়ালার নম্বর ফোনে সেভ করে রাখসি, তার সঙ্গে ফোনে কথা বলি। বাদামের টাকা আমার কাছ থেকে নিতে বলি। আমার স্বামী শুধু বাদাম নিয়ে আসে, বাদামের হিসাব আমার কাছে থাকে।’

হেমা জানান, দুই সপ্তাহ আগে তাদের একটি সন্তান জন্ম নিয়েছে। তারও দেখভাল করেন হেমা। ব্র্যাকের দেওয়া সেই এক ছাগলের বদৌলতে এখন তার ছাগলের সংখ্যা চারটি। বাদামের ব্যবসা করে জমি বন্ধক নিয়েছেন। সেখানে ধান চাষ করেন। তিনি বলেন, ‘আমার এখন সন্তান হইসে। আমি আর বাবার বাড়ি থাকবো না। জমি কিনে বাড়ি করার স্বপ্ন আছে। এই স্বপ্ন দেখার জন্য আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস আসছে ব্র্যাকের কারণেই।’          

ব্র্যাক জানায়, চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা দ্বিগুণ বোঝার মুখোমুখি হন। তারা একটি সুখী ও স্বাধীন জীবন অনুসরণ করার আশা হারিয়ে ফেলেন। সমাধান হিসেবে, পুনর্বাসন ও মনোসামাজিক কর্মকর্তাদের লক্ষ্যযুক্ত মূল্যায়ন এবং কাউন্সেলিংয়ের জন্য নিযুক্ত করার মাধ্যমে এই কাজটি করা হয়ে থাকে। ব্র্যাকের কর্মীরা অক্ষমতার তীব্রতা ও অংশগ্রহণকারীদের সামগ্রিক মনোসামাজিক অবস্থা শনাক্ত করেন। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো এরপর তৈরি করা হয়। যার মধ্যে থেরাপি, তাদের যত্নশীল হওয়ার প্রশিক্ষণ এবং তারা যে পরিবেশে বাস করে সেখানে অভিযোজনগুলো একটি সক্ষম পরিবেশের মাধ্যমে যে কোনও বাধা অতিক্রম করার জন্য তৈরি করা হয়।

ব্র্যাক আরও জানায়, ২০০২ সালে শুরু হওয়া বাংলাদেশে ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন (ইউপিজি) প্রোগ্রাম, আনুষ্ঠানিকভাবে টার্গেটিং দ্য আলট্রা-পুওর (টিইউপি) প্রোগ্রামের মাধ্যমে এই গ্র্যাজুয়েশন পদ্ধতি বাস্তবায়ন করছে। তারা ২০ লাখেরও বেশি পরিবারকে চরম দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করেছে।

Place your advertisement here
Place your advertisement here