• শনিবার ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ২০ ১৪৩১

  • || ৩০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

Find us in facebook

‘শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে মন ভরে কথা বলতাম’ 

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১৯ মার্চ ২০২০  

Find us in facebook

Find us in facebook

১৯২৫ সালের ১ মার্চ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার মীর বাজার এলাকায় মুসলিম পারিবারে জন্মগ্রহণ করেন ইয়াকুব আলী। ১৯৪৪ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছেন পাঁচলা আজিম ইনস্টিটিউট থেকে। ইন্টারমিডিয়েট ও গ্র্যাজুয়েশন করেছেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে।

বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী ইয়াকুব আলী ৯৫ বছরেও বন্ধুর কথা বিন্দু পরিমাণ ভোলেননি। তিনি বলেন, আজও বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুব বেশি মনে পড়ে। ও বেঁচে থাকলে তার সঙ্গে দেখা করে মন ভরে কথা বলতাম। আমার শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। তাই আমার শেষ ইচ্ছে টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কবর জিয়ারত করা। আর ওর মেয়ে শেখ হাসিনাকে দোয়া করা। কারণ বঙ্গবন্ধুর অনেক গুণ শেখ হাসিনার মধ্যে আছে।

বঙ্গবন্ধুর সব স্মৃতির কথা স্মরণ করে টপ টপ করে বলতে পারেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ‘বেকার’ হোস্টেলে ছিলেন তিনি। কলেজ জীবনের বন্ধুত্বের স্মৃতিচারণ করে একান্ত আলাপচারিতায় ডেইলি বাংলাদেশকে ইয়াকুব আলী বলেন, নেতা হিসেবে সবার সঙ্গে শেখ মু‌জি‌বুর রহমান একই রকম ব্যবহার করতেন। তার বাড়ি থেকে কোনো খাবার নিয়ে আসলে আমাকে ছাড়া খেত না। ইসলামিয়া কলেজে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমরা ছাত্র সংগঠন করেছি। এই সংগঠনের নাম ছিল অল বেঙ্গল ইস্ট মুসলিম লীগ। মাইকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনলেই বিভিন্ন স্মৃতি আমাকে তাড়া করে। স্মৃতিচারণ করে এই কথাগুলো বলছিলেন কলকতা ইসলামিয়া কলেজে বঙ্গবন্ধুর বন্ধু ইয়াকুব আলী খান।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতায় যখন পড়াশোনা করতেন ছাত্র অবস্থায় তার মধ্যে নেতৃত্বের গুণ ছিল লক্ষ্যণীয়- বলেন ইয়াকুব আলী। তিনি বলেন, আমরা একসঙ্গে চলাফেরা করেছি, আড্ডা দিয়েছি এবং লেখাপড়া করেছি। একইসঙ্গে বিএ পরীক্ষা দিয়েছি। একই রুমে আমার ও শেখ মুজিবের সিট পড়েছিল। আমি তখন বেকার হোস্টেলের ১০৩ নম্বর রুমে থাকতাম।

সহপাঠী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল জানতে চাইলে ইয়াকুব আলী বলেন, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল খুব গভীর, আন্তরিক। এ কারণেই একে অপরকে ‘তুই’ করে বলতাম।  তুই করে বলার কারণে আজও বঙ্গবন্ধুর কথা বা স্মৃতি বেশি মনে পড়ে। যখন কোনো টিভি বা পেপারে  তার কথা বলে বা কোনো মাইকে তার ভাষণ শোনা যায় তখন বিভিন্ন স্মৃতির কথা মনে পড়ে।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম কোথায় পরিচয় হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যখন ইসলামিয়া কলেজে ইতিহাসে ভর্তি হয়ে ক্লাস শুরু করি তখন আমাদের সঙ্গে ২০ শিক্ষার্থী ছিল। তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রথম কথা হয় কলেজে। আমরা দুইজন একই সাবজেক্টের ছাত্র ছিলাম। আমার বাড়ি হাওড়া হওয়ায় মুজিব আমাকে হাওড়া বলে ডাকতেন। মুজিব ও আমি যখন ‘বেকার’ হোস্টেলে ছিলাম তখন হোস্টেল সুপারিন্ডেন্ট ছিলেন প্রফেসর সাইদুর রহমান। হোস্টেলে আরো অনেক বন্ধু ছিলো। ফরিদপুরের শামসুদ্দিন মোল্লা। পরে শামসুদ্দিন মোল্লা ফরিদপুরের গভর্নর নির্বাচিত হন। এছাড়া বন্ধুদের মধ্যে রয়েছে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন (দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক ছিলেন)। তার কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর খোঁজ-খবর নিতাম। আমাদের সঙ্গে আরো পড়তেন পাবনার খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, যিনি ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’ বই লিখে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। মহিউদ্দিন আহমেদ, যিনি ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকায় ছিলেন সালাউদ্দিন আহমেদ। তাদের সবার সঙ্গে আমার ‘তুই-তোকারি’ সম্পর্ক ছিল।

পড়াশোনা শেষ করার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কতবার দেখা হয়েছে এবং কোথায়? এ বিষয়ে ইয়াকুব আলী বলেন, দুই বার দেখা হয়েছে কলেজ ছাড়া পর। আমি যখন চাকরি করতাম, তখন আমার সঙ্গে মাদারীপুরের এক ভদ্রলোক চাকরি করতেন আমার সেকশনে। তার নাম আব্দুল মান্নান শিকদার। আমাদের অফিসে ফনী মজুমদারসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতারা আসতেন। তারা আসলে আমি অফিসে প্রায়ই বলতাম বঙ্গবন্ধু আমার ক্লাসমেট। এরপর মান্নান সিকদার একদিন আমাকে বলল খান সাহেব একটা কাজ করেন। আজ সন্ধ্যায় আমাদের লোকাল বিষয় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাবো। আপনি আমাদের সঙ্গে যাবেন। জোরাজুরি করে আমাকে নিয়ে গেল। ৩০-৪০ জন লোক বসা ছিল। তার পেছনে আমি গিয়ে বসলাম। শেখ সাহেব প্রবেশ করেই বললেন, এই ইয়াকুব তুই এখানে বসে কি করিস?  আমি অবাক হয়ে গেলাম, এতো বছর পর দেখা, তারপরেও প্রথম দেখায় চিনে ফেলল। আমি বললাম আমার কোনো কাজ নেই। তোর দেশের লোকেরা আসছে, ওদের কি কাজ আছে। আমি শুধু তোকে দেখতে আসছি, এখন তুই বড় নেতা।

তিনি আরো জানান, আরেকবার তিন নেতার মাজারে দেখা হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কবরে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা রেলিংয়ের বাইরে, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলাম। ৩০-৪০ হাত দূর থেকে দেখে বঙ্গবন্ধু ডাক দিলেন ‘ওই ইয়াকুব ওখানে কেন?  ভিতরে আয়।’

ইয়াকুব আলী জানান, তবে দেশ স্বাধীন হওয়া পর মুজিবের সঙ্গে দেখাও হয়নি, কথাও হয়নি। এমনকি আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও যাইনি। শুনছি বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ নিয়ে, দেশ গঠনের জন্য অনেক সমস্যা আছেন। আমি গিয়ে আমার ব্যক্তিগত সমস্যার কথা বলে কি তার সমস্যা বাড়িয়ে দেব? এই চিন্তা করেই যাইনি।

ইসলামিয়া কলেজে পড়াশোনা শেষ করে আপনি কি করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইসলামিয়া কলেজ থেকে ডিগ্রি সম্পন্ন করে ১৯৫০ সালে আমি সরকারি চাকরিতে যোগদান করি। মিনিস্ট্রি অব প্ল্যানিং এর আওতায় পূর্ব পাকিস্তানের পরিসংখ্যান ব্যুরোতে কাজ শুরু করি। ১৯৬৪ সালে মিরপুরে এই জায়গাটুকু অ্যালটমেন্ট পাই। সেই সময় থেকেই এখানে বসবাস করছি। এর বাইরে দেশের কোথাও আমার আর কোনো সম্পত্তি নেই।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আপনার শেষ ইচ্ছা কী? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান তো আর বেঁচে নেই, বেঁচে থাকলে তার সঙ্গে দেখা করে মন ভরে কথা বলতাম। এখন আমার ইচ্ছে হলো- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের টুঙ্গিপাড়ার কবর জিয়ারত করা। ওর মেয়ে শেখ হাসিনাকে দোয়া করা। কারণ বঙ্গবন্ধুর অনেক গুণ শেখ হাসিনার মধ্যে আছে। আমার শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। কবে মারা যাই, বলা তো যায় না। একবার যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে দোয়া করতে পারতাম, তাহলে মনে শান্তি পেতাম।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা স্মরণ করে ইয়াকুব আলী বলেন, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার খবর শোনার পর খুবই খারাপ লেগেছে, অনেক কেঁদেছি। মুজিব এই দেশের মানুষকে খুব ভালোবাসতেন। জেলে গেছেন অনেকবার। মুজিবের বড় একটা গুণ ছিলো সবাইকে ক্ষমা করে দিতেন। আর তাকেই নাকি মেরে ফেলল।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে-পালিয়ে থেকেছি। বঙ্গবন্ধুর ক্লাসমেট হওয়ায় ভয়ে ভয়ে থাকতাম, কেউ যদি পাকিস্তানিদের কাছে বলে দেয়, ইনি বঙ্গবন্ধুর ক্লাসমেট।
 
২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত মুজিববর্ষ পালন করা হবে- এ বিষয়ে ইয়াকুব আলী বলেন, আমার বন্ধুর নামে বছর ঘোষণা করা হয়েছে। এই কথা শুনে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে, খুব খুশি আমি। শুধু বাংলাদেশে নয়, ইউনেস্কোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুজিববর্ষ পালন করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নি‌য়েছে সরকার। তি‌নি  আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, এই কর্মসূচি জানতে পেরে আমি কি পরিমাণ খুশি হয়েছি, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।

Place your advertisement here
Place your advertisement here