• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook
সর্বশেষ:
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অন্যতম নকশাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস, আজ ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। বন্যায় দুবাই এবং ওমানে বাংলাদেশীসহ ২১ জনের মৃত্যু। আন্তর্জাতিক বাজারে আবারও বাড়ল জ্বালানি তেল ও স্বর্ণের দাম। ইসরায়েলের হামলার পর প্রধান দুটি বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল শুরু। ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরানে।

২১শে আগস্ট হামলা ১৫ই আগস্টের ধারাবাহিকতা

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৭ আগস্ট ২০২০  

Find us in facebook

Find us in facebook

আবদুল মান্নান

২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশস্থলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা ছিল মূলত পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে পরিচালিত ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্তকরণ পরিকল্পনার একটি অংশমাত্র। এই উদ্দেশ্যেই ঘাতকেরা ১৫ই আগস্ট শুধু বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলা করে ক্ষান্ত হয়নি, তারা তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় শেখ ফজলুল হক মনি ও আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতেও একই সময়ে হামলা করে সেখানেও নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালায়। ঘটনাচক্রে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেদিন প্রাণে বেঁচে যান। কারণ সে সময় তারা দুজনই শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার তত্কালীন কর্মস্থল জার্মানিতে ছিলেন।

২০০৪ সালে আওয়ামী লীগ সংসদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিরোধী দল আর সরকারে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। জোটের অন্য শরিকদের মধ্যে আছে একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও কামারুজ্জামান বেগম জিয়ার কেবিনেটে মন্ত্রী। বেগম জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে জঙ্গিদের অভয়ারণ্য। আগস্টের ১৭ তারিখ দেশের ৫০০ স্থানে একই সঙ্গে জঙ্গিদের বোমাবাজির ঘটনা ঘটে। যেদিন এ ঘটনা ঘটে, ঠিক সেই দিন বেগম জিয়া চীনে যাচ্ছিলেন। এয়ারপোর্টের কাছেও একটি বোমা ফাটে। সাংবাদিকেরা তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানের কাছে এই অভাবিত ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি পুরো বিষয়টাকে ‘কিছু রকবাজের কাণ্ড’ বলে উড়িয়ে দেন। এর আগে ১ এপ্রিল চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক আধুনিক অস্ত্রের একটি বড় চালান ধরা পড়ে। পরে জানা যায়, এই অস্ত্র পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চোরাই পথে আনা হয়েছিল। বেগম জিয়ার শাসনামলে সারা দেশ হয়ে পড়ে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য। সেদিন আওয়ামী লীগের সমাবেশটি আসলে ছিল একটি সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ। প্রথমে হওয়ার কথা ছিল জিপিওর পাশে উন্মুক্ত মঞ্চে। সেখানে করার অনুমোদন না পাওয়ার কারণে তা স্থানান্তর করা হয় দলীয় কার্যালয়ের সামনে। এই মর্মে সেদিনের কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়।

শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য সভায় গ্রেনেড হামলা করাটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। সে কারণেই হয়তো নির্ধারিত স্থানে সমাবেশের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। কারণ সেখানে কোনো উঁচু দালান ছিল না, যার সুবিধা সন্ত্রাসীরা নিতে পারে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের অফিসের সব দিক উঁচু ভবন। সেদিনের সভায় কোনো মঞ্চ ছিল না। সেদিন একটি ট্রাককে মঞ্চ বানিয়ে সেখান থেকেই নেতারা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। সব শেষ বক্তা দলের প্রধান ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। তিনি তার বক্তৃতা শেষ করে ট্রাক থেকে নিচে নামার ঠিক পূর্বমুহূর্তে এই হামলা হয়। সেদিন মোট ১৪টি গ্রেনেড সেখানে বিস্ফোরিত হয়। বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। ব্যবহার করা হয়েছিল সেনাবাহিনীতে ব্যবহূত আর্জেস গ্রেনেড। শেখ হাসিনাকে রক্ষা করার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের সৃষ্ট মানববর্মের কারণেই সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা বেঁচে যান। ঠিক একই কায়দায় এরশাদ আমলে চট্টগ্রামে পুলিশের বেপরোয়া গুলিবর্ষণের হাত থেকে আর একবার তাকে রক্ষা করা হয়েছিল। সেদিন পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৪ জন নেতাকর্মী। আর ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলায় দলের ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছিলেন, আহত হয়েছিলেন প্রায় ৩০০, যাদের মধ্যে অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে পড়েন। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন আওয়ামী লীগের নেতা জিল্লুর রহমানের (পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি) স্ত্রী মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আইভি রহমান।

২১শে আগস্টের ঘটনা তদন্তে হাইকোর্টের বিচারপতি জয়নুল আবেদিনকে দিয়ে এক সদস্যবিশিষ্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বিচারপতি জয়নুল আবেদিন তার রিপোর্টে বলেন, এই হামলার সঙ্গে বিদেশি শক্তি (পড়ুন ভারত) জড়িত আছে। একজন বিচারপতির এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি ক্ষমার অযোগ্য। বেগম জিয়া পরবর্তীকালে এই জয়নুল আবেদিনকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন। জিয়া থেকে শুরু করে বেগম জিয়া, যারাই তাদের বিভিন্ন অবৈধ কাজে সহায়তা করেছেন, তাদের সবাই নানাভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন। আর সংসদে বিএনপির সংসদ সদস্যরা বলেন, শেখ হাসিনা নিজেই তার ভ্যানিটি ব্যাগে গ্রেনেড বহন করে তা ছুড়ে মেরেছিলেন। বেগম জিয়া বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় সফলতা দেখে ঈর্ষাণ্বিত হয়ে এই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগ জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরানোর জন্য।

হামলার পরে আসে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন। সিআইডির কর্মকর্তা রুহুল আমিন সাজায় জজ মিয়া নাটক। হামলার পর আওয়ামী লীগ মামলা দিতে গেলে রমনা থানা মামলা নিতে অস্বীকার করে। বলে, ওপরের নির্দেশ লাগবে। বিচারপতি জয়নুল আবেদিনের রিপোর্ট আর জজ মিয়াতেই ২০০৬ সালে শেষ হয় বেগম জিয়া সরকারের মেয়াদ। তিনি তার মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তা রুখে দেয় জনগণ। তারপর আসে এক-এগারো। বেগম জিয়ার শাসনামলেই প্রথম একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিকের একটি পাক্ষিক পত্রিকায় (অধুনালুপ্ত) প্রকাশিত হয় ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তারেক জিয়া, হাওয়া ভবন, জামায়াত, জেএমবি, রাষ্ট্রের তত্কালীন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থা, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে। বেগম জিয়ার পর এক-এগারোর সরকার ক্ষমতায় এলে তারা পুরো ঘটনা পুনঃতদন্ত শুরু করে এবং ধীরে ধীরে সব সত্য উদ্ঘাটিত হতে থাকে। ২০০৭ সালের জুন মাসে সিআইডি ২২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়। আটক হয় জঙ্গি মুফতি হান্নান, বিএনপির একসময়ের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু। উঠে আসে প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরীর সম্পৃক্ততার কথা। ২০১১ সালের জুলাই মাসে সিআইডি একটি সম্পূরক চার্যশিট দেয়, যাতে ৩০ জনের নাম ছিল, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন বেগম জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান ও তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর। মুফতি হান্নান তার দেওয়া সাক্ষ্যে আদালতকে বলেন, ২১শে আগস্টের ঘটনার পূর্বে তারা শেখ হাসিনাকে হত্যার সব পরিকল্পনা করত তারেক রহমানের হাওয়া ভবনে বসে। সেখানে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আসত আর মাঝে মাঝে আসত জামায়াতের কয়েক জন নেতা। এই হামলার জন্য ব্যবহূত গ্রেনেড সরবরাহ করেন আবদুস সালাম পিন্টু।

২১শে আগস্টের এই ঘৃণ্য হামলার জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার হয় বিশেষ আদালতে। বিশেষ আদালত দীর্ঘ শুনানির পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর তার রায় ঘোষণা করে। রায়ে লুত্ফুজ্জামান বাররসহ ১৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় আর তারেক রহমানসহ ১৮ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তত্কালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক আশরাফুল হুদা ও শহিদুল হককে চার বছর করে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ইতিমধ্যে তারেক রহমান জিয়া অরফানেজ মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। তারেক রহমান বর্তমানে লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে আইনের দৃষ্টিতে পলাতক জীবন যাপন করছেন। হারিছ চৌধুরী (যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত) বেগম জিয়ার ক্ষমতা হারানোর পর থেকেই পলাতক। দণ্ডপ্রাপ্তরা উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন। ইতিমধ্যে আদালতের নিয়ম অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টে পেপার বুক পৌঁছেছে।

রাজনীতিতে মতভেদ থাকবে, কিন্তু তাই বলে একজন রাজনৈতিক নেতাকে সদলবলে হত্যা করার চেষ্টা করা হবে তা সাধারণত একটি বিরল ঘটনা। এই দুর্বৃত্তায়নের সূচনা সেনাশাসক ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়ার হাতেই বাংলাদেশে এসেছে। তিনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সব পরিকল্পনার কথা জেনেও তা গোপন করেন এবং এই হত্যা-ষড়যন্ত্রের সঙ্গে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে শামিল হন। তারই ছেলে তারেক রহমান বঙ্গবন্ধুকন্যাকে হত্যা করার পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত হয়ে এই দুর্বৃত্তায়নে একটি নুতন মাত্রা যোগ করেছে।

সবশেষ একটা মন্তব্য করে শেষ করতে চাই। একটি ১৫ই আগস্ট ঘটানোর জন্য যে ষড়যন্ত্র বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল, তা একটি ২১শে আগস্টের ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যায়নি। বর্তমানের ষড়যন্ত্র আরো বেশি শাণিত হতে পারে, ঘটতে পারে অন্য কোনো বিপত্তি। অতএব, সংশ্লিষ্ট সবার সাবধানে থাকাটা খুবই জরুরি।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক।

সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক।

Place your advertisement here
Place your advertisement here