• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook
সর্বশেষ:
মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ইতিহাসে অনন্য: রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিরা হস্ত‌ক্ষেপ করবে না: ওবায়দুল কাদের লালমনিরহাটে যুবলীগ কর্মীর পায়ের রগ কাটলেন যুবদল নেতা বাসার ছাদ থেকে পড়ে যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু ঠাকুরগাঁওয়ে ঈদ-নববর্ষে ১০ জন নিহত, আহত ২ শতাধিক

হারিয়েছেন সব, গানই এখন সম্বল বৃদ্ধা শিল্পীর

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৪ এপ্রিল ২০২১  

Find us in facebook

Find us in facebook

গ্রামবাসীর কুৎসা উপেক্ষা করে যন্ত্র ছাড়াই গান গেয়ে নিঃসঙ্গতা কাটান শিক্ষা অফিসারের মেয়ে বৃদ্ধা রাশিদা খানম শিল্পী (৬০)। পৃথিবীতে আপনজন বলতে তার কেউ নেই। জীবনের প্রায় সময়টাই কটিয়েছেন অর্ধভুক্ত-নিঃসঙ্গ একাকী।

রাশিদা খানম শিল্পী বগুড়ার কাহালু উপজেলার কালাই ইউনিয়নের উত্তর কার্নিপাড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষা অফিসার (এটিও) মৃত হবিবর রহমান খানের মেয়ে। তিনি বর্তমানে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়নের তালুক হরিদাস গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষা অফিসার (এটিও) গিয়াস উদ্দিনের আশ্রয়ে রয়েছেন।

রাশিদা খানম জানান, সহকারী শিক্ষা অফিসার হবিবর রহমান খান ও মনিরা বেগমের সংসারে একমাত্র সন্তান রাশিদা খানম। জন্মের চার মাস পরে মা মনিরা বেগমের মৃত্যু হলে রাশিদার শৈশব কাটে ফুপু হামিদা বানুর কোলে। এরই মধ্যে দ্বিতীয় বিয়ে করেন তার বাবা। ৬-৭ বছর বয়সে ফুপুর বাড়ি থেকে পুনরায় বাবার বাড়িতে ঠাঁই হয় তার।  

সৎ মায়ের বিরূপ আচরণে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তাকে। শিক্ষিত বেকার স্বামী ইসহাক আলীকে একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের চাকরি পাইয়ে দেন তার বাবা হবিবর রহমান। সংসার জীবনে একটি মেয়ের জন্ম হয়। মেয়েটির নাম রাখেন ইসমত আরা লাকি। কিন্তু স্বামীর চাকরিই যে তার জীবনের কালো অধ্যায়ের সূচনা করেবে তা কে জানতো।

চাকরির সুবাদে রাশিদার স্বামী ইসহাক বাইরে লজিং থাকতেন। সেখানে এক মেয়ের সঙ্গে পরকিয়ায় জড়িয়ে বিয়ে করেন। এরপর হঠাৎ রাশিদাকে তালাক দিয়ে চিঠি পাঠান তার স্বামী। মেয়ের তালাকের চিঠি হাতে পেয়ে অফিসেই স্টোক করে মারা যান রাশিদার বাবা সহকারী শিক্ষা অফিসার হবিবর রহমান। স্বামী পরিত্যক্তা বাবাহীন জীবনে একমাত্র অবলম্বন ৯ মাসের মেয়ে ইসমত আরা লাকি। সেই মেয়েকেও একদিন কেড়ে নিয়ে লুকিয়ে রাখেন রাশিদার সৎ মা আর তার লোকজন।

স্বামী, বাবা ও সন্তানকে হারিয়ে রাশিদা আত্মহত্যা করতে পুকুরে ঝাঁপ দেন। কিন্তু প্রতিবেশীদের জন্য সে যাত্রায় বেঁচে যান তিনি। এরপর রেললাইনে আত্মহত্যা করতে ট্রেনে উঠে চলে আসেন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার রইসবাগ স্টেশনে। সেখানে ট্রেন দাঁড়ালে ট্রেন থেকে নেমে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন রশিদা। ভাগ্যক্রমে হরিদাস উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল কাদেরের হস্তক্ষেপে বেঁচে যান তিনি।

তখন হাজারো জনতা ভিড় জমায়। পরিচয়সহ জীবনের করুণ কাহিনী বর্ণনা করেন রাশিদা। স্থানীয়দের দাবিতে রাশিদার ঠাঁই হয় স্কুলশিক্ষক কাদেরের বাড়িতে। স্কুলশিক্ষক নিজের দুই মেয়ের সঙ্গে রশিদাকেও গান শিখান। সেখানে গান শিখে রংপুর বেতারে সহশিল্পী হিসেবে বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি। গান করার কারণে রশিদার নামটি মুছে গিয়ে ‘শিল্পী’ নামেই পরিচিত হন। এলাকার সবাই তাকে এখন শিল্পী বেগম নামেই চেনেন।

জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম হয় শিল্পী বেগম। আশ্রয়দাতা স্কুলশিক্ষক আব্দুর কাদেরের মৃত্যু হলে তারুক হরিদাস গ্রামে আনাচে কানাচে পলিথিনের ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করেন শিক্ষা অফিসারের মেয়ে শিল্পী বেগম। বিষয়টি অমানবিক ভেবে তালুক হরিদাস গ্রামের সহকারী শিক্ষা অফিসার গিয়াস উদ্দিনের মেয়ে রোকসানা আরা মুক্তা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সহায়তার আবেদন জানালে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে শিল্পী বেগমের খোঁজ খবর নেন আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন।  

শিল্পীকে ঘর দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও জমি নেই। তাই বাধ্য হয়ে সমাজকর্মী রোকসানা আরা মুক্তা তাদের বাড়ির পাশের দুই শতাংশ জমি শিল্পী বেগমের নামে লিখে দিলে সেই জমিতে প্রধানমন্ত্রীর উপহার ঘর করে দেন ইউএনও মনসুর উদ্দিন।

প্রতিবেশীরা কিছু দিলে পেটে ভাত জোটে নয়তো না খেয়ে দিন কাটে শিল্পী বেগমের। জীবনের চরম দৈন্যদশা পাড়ি দিয়ে বার্ধক্যে এসে হারানো সন্তানকে খুঁজছেন নিসঙ্গতা কাটাতে। মাতৃস্নেহের টানে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে বিনা মজুরিতে শিশুদের গান শেখান শিল্পী বেগম। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সাহায্য দিলে তা দিয়ে জ্বলে শিল্পী বেগমের চুলো। করোনায় বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় নিদারুণ মানসিক ও আর্থিক কষ্টে পড়েন বৃদ্ধা শিল্পী বেগম। কাউকে পাশে পেলে আপন ভেবে গল্প আর গানে মাতিয়ে রাখেন।

নিঃসঙ্গতা কাটাতে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের বাড়িতে বসে বসে গান গেয়ে দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু গ্রামবাসীর পছন্দ না হওয়ায় তারা কুৎসা রটান। আশ্রয়দাতাকে চাপ দেন শিল্পীকে সরাতে। কিন্তু মানবিক শিক্ষা অফিসার গিয়াস উদ্দিন তার সহকর্মীর মেয়েকে অজানা গন্তব্যে সরাতে নারাজ। গ্রামবাসীর কুৎসকে উপেক্ষা করে গান গেয়ে নিঃসঙ্গতা কাটান শিল্পী বেগম।

জীবনের করুণ চিত্র বর্ণনা করে কান্না থামাতে পারেনি শিল্পী বেগম। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীতে যার কেউ নেই, সেই বুঝে নিঃসঙ্গতা কতো কষ্টের। না খেয়েও সময় কেটে যায়। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে একাকী সময় কাটানো অত্যন্ত কঠিন। সমাজের কেউ এগিয়ে এলে প্রধানমন্ত্রীর ঘরের পাশে একটা দোকান বা সামান্য ডাল ভাত উপার্জনের ব্যবস্থা করলে খুব উপকার হতো। ’

শিল্পী বেগমকে আশ্রয়দাতা সমাজকর্মী রোকসানা আরা মুক্তা বলেন, জীবনের কঠিন নির্মমতার শিকার শিল্পী বেগম। একজন শিক্ষা অফিসারের মেয়ের মানবেতর জীবনের সঙ্গে নিজের জীবনকে তুলনা করেছি। সেই মানবিকতার টানে বাবার সহকর্মীর মেয়েকে জমি লিখে দিয়েছি। শিল্পী বেগম নিঃসঙ্গতা কাটাতে গান গেয়ে সময় কাটান। সেটা গ্রামের অনেকের পছন্দ না। তা নিয়ে আমাদের অনেক কথা শুনতে হয়। শিল্পী বেগমের জন্য স্থায়ীভাবে সামান্য উপার্জনের পথ সৃষ্টি করতে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

Place your advertisement here
Place your advertisement here