• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook
সর্বশেষ:
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অন্যতম নকশাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস, আজ ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। বন্যায় দুবাই এবং ওমানে বাংলাদেশীসহ ২১ জনের মৃত্যু। আন্তর্জাতিক বাজারে আবারও বাড়ল জ্বালানি তেল ও স্বর্ণের দাম। ইসরায়েলের হামলার পর প্রধান দুটি বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল শুরু। ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরানে।

ভাসানীর শ্বশুরবাড়ির খড়ের গাদায় ঘুমিয়ে মুজিব

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৩ অক্টোবর ২০২০  

Find us in facebook

Find us in facebook

অজয় দাশগুপ্ত

৯, ১০ অক্টোবর, ১৯৫৫। জয়পুরহাটের তেঘর মাদ্রাসা মাঠে আওয়ামী মুসলিম লীগের উত্তরবঙ্গ কর্মী সম্মেলন। ৮ অক্টোবর গভীর রাতে মুজিব নেমেছেন ট্রেন থেকে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি রেল স্টেশনে।

স্টেশন মাস্টার মুজিবকেঃ স্যার, এই রাতেই বীরনগর যাবেন? না-কি স্টেশনে ঘুমিয়ে থাকবেন?

মুজিবঃ মাস্টার সাহেব, ওই যে দূরে দেখছেন একটা লোক দাঁড়ানো, টিকটিকি। ময়মনসিংহ থেকে ওনার দায়িত্ব পড়েছে আমার ওপর নজর রাখার। ওনার টর্চ লাইট আছে। এক ব্যাটারি। আমারও আছে, দুই ব্যাটারি। দু’জনে চলে যাব, অসুবিধে হবে না।

স্টেশন মাস্টারঃ স্যার, সরকারি চাকরি করি। সব কথা বলতে পারি না। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে কত রাজনীতিবিদ দেখেছি। আপনার মতো কাউকে পাই নাই। ভাসানী সাহেব মাঝেমধ্যেই থাকেন বীরনগর শ্বশুরবাড়িতে। আপনি ঢাকা থেকে লোকাল ট্রেনে ময়মনসিংহ, বাহাদুরাবাদ, বগুড়া হয়ে পাঁচবিবি আসেন। তারপর হেঁটে চলে যান বীরনগর। এত কষ্টের ফল নিশ্চয়ই আল্লাহ দেবেন আপনাকে।

মুজিবঃ এই কষ্ট করি দেশের জন্য। বাংলার মানুষ যেন ভাল থাকে, সেজন্য। দোয়া করবেন, যেন কামিয়াব হই। ভাসানী সাহেব দলের প্রেসিডেন্ট। আমি সেক্রেটারি। উনি বীরনগর কিংবা টাঙ্গাইলের সন্তোষে থাকেন। সন্তোষ যেতে একই ধরনের কষ্ট। আমি গায়ে মাখি না।

মুজিব গোয়েন্দাকে ইশারায় কাছে ডাকেন।

গোয়েন্দাঃ আমাকে বলছেন?

মুজিবঃ চলেন ভাই, বীরনগর রওনা দিই। এখন তো আমি আপনার হেফাজতে। ভাসানী সাহেব নাস্তা রেডি রাখবেন।

হাঁটতে হাঁটতে গোয়েন্দা, একটা বাঁশের সেতুতে উঠতে পারছেন না। মুজিব তুলে দিলেন তাকে।

গোয়েন্দাঃ এই রাস্তায় আপনি নিয়মিত চলাচল করেন? আমি আরেকবার এসেছি। তবে দিনের বেলা।

মুজিবঃ আমি নিয়মিত আসি হুজুরের কাছে। আপনাদের যেই থাকে সে-ই আমার সঙ্গী। তবে ভাসানী সাহেব কিন্তু সবার দিকে নজর রাখেন। আপনার অসুবিধে হবে না।

দু’জনে পৌঁছে গেলেন বীরনগরে।

গোয়েন্দাঃ রাত তিনটা বাজে। আপনি তো ভাসানী সাহেবের ঘরে থাকবেন। আমার জন্য তো কোনো ব্যবস্থা নাই।

মুজিবঃ চিন্তা করবেন না। আমি রাতে এলে হুজুরকে ডাকি না। এত রাতে কারও ঘুম ভাঙানো ঠিক না। ওই যে খড়ের গাদা দেখছেন, সেখানেই বিশ্রাম নিই। হুজুর ফজরের নামাজ পড়ে আমাকে ঘরে ডেকে নেন। চাচী নাস্তা নিয়ে আসেন। তাতেই আমার মন ভাল হয়ে যায়। আসেন, দু’জনেই কার্ত্তিক মাসের মশার কামড় খেতে খেতে বাকি রাত কাটিয়ে দিই।

গোয়েন্দা ও মুজিব খড়ের গাদায় পাশাপাশি।

গোয়েন্দাঃ স্যার, কেউ যদি এভাবে আমাদের  দেখে ফেলে, আমার চাকরি যাবে। বউ-বাচ্চা না খেয়ে মরবে।

মুজিবঃ ভয় নাই, এত রাতে আপনাদের আর কেউ নজর রাখবে বলে মনে হয় না। এখন তো কার্ত্তিক মাস। সামনের মাস অঘ্রাণে নতুন আমন  ধান উঠবে। নতুন ধানের খড়ের গন্ধ খুব ভাল লাগে আমার। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, অঘ্রাণে ভরা খেতের গন্ধ পাগল করে দেয়। স্টেশনে শুয়ে থাকলে বই পড়ি। গ্রামে আসলে ধানের গন্ধ ভাল লাগে। চুপচাপ শুয়ে থাকি।

গোয়েন্দাঃ স্যার, আপনি জানেন না। আপনার ওপর আমাদের কয়েকজনকে নজর রাখতে হয়। কাগজে কলমে আপনি ওয়ান-স্টার সাসপেক্ট, ভাসানী সাহেব টু-স্টার। কিন্তু নজরদারিতে আপনিই এক নম্বরে। এই এলাকায় ভাসানী সাহেবের ওপর নজর রাখার লোকও আছে।

মুজিবঃ ভয় নাই, পারলে একটু ঘুমিয়ে নেন। এই বিস্কুটটা মুখে দিয়ে নেন। ভাসানী সাহেব নামাজ শেষ হলে পানি নিয়ে আসবেন। সেটা খেয়ে নেবেন।

ভাসানী সাহেব আরেক সঙ্গীসহ এগিয়ে এলেন খড়ের গাদার কাছে। হাতে মাটির বদনায় পানি। মুজিব ও গোয়েন্দা ঘুমিয়ে আছেন।

সঙ্গীকে ভাসানীঃ দেখ, এই হলো  মুজিবর, আমার ঘুম ভাঙায় নাই। নিজে ঘুমিয়ে আছে খড়ের গাদায়। কত বলি, রাতে ডাকলে সমস্যা নাই। কিন্তু কিছুতেই ডাকবে না।

সকাল হতেই মুজিব উঠে পড়ে। হুজুরকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম দেয়।

ভাসানীঃ কেন যে ডাক না? সাপ থাকে, বিষাক্ত পোকা থাকে। শেয়াল ঘুরে বেড়ায় মুরগি-ছাগল ধরার জন্য। তোমাকে নিয়া আমি ভয়ে থাকি। এখানেই তোমার চাচীকে সাপে কেটেছিল, মনে নাই?

মুজিব চোখ ডলতে ডলতেঃ হুজুর, এ সব নিয়ে ভাববেন না।

দাওয়ায় বসে মুজিব ও ভাসানী।

ভাসানীঃ ১০ দিন পর ঢাকায় আওয়ামী লীগের সম্মেলন। এবারে আওয়ামী মুসলিম লীগকে আওয়ামী লীগ করতে হবে। উত্তরবঙ্গের সব কাউন্সিলরা যেন এ প্রস্তাবে একমত হয়, সে জন্য এই সম্মেলন  ডেকেছি। যশোরে দক্ষিণবঙ্গের কর্মীদের একই কারণে ডেকেছিলাম।

মুজিবঃ হুজুর, আপনার এই কৌশলটা খুব ভাল। অনেকে পছন্দ করে না, কারণ তাদের কষ্ট হয়।

ভাসানীঃ আমি জানি, তুমি কর্মী সম্মেলনের আগে আমার সঙ্গে পরামর্শের জন্য এখানে আসবা। শোন, সোহরাওয়ার্দি সাহেব বেকে বসলে কিন্তু সব ভেস্তে যাবে। তুমি মানিক মিয়াকে দিয়ে ওনাকে রাজী করাবা।

মুজিবঃ আমি জেলায় জেলায় কথা বলেছি। সালাম সাহেবসহ কয়েকজনের ঘোর আপত্তি। মুসলিম লীগও উস্কানি দিচ্ছে। যুক্তফ্রন্টের নেজামে ইসলামও অপপ্রচার চাচ্ছে। শেরে বাংলার কেএসপির নামে ‘মুসলিম’ নাই। তাতে কোনো সমস্যা দেখে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিয়েই যত মাথা ব্যথা।

আলেমা ভাসানী মাটির থালায় জাউ ভাত ও কুমড়ার ভর্তা নিয়ে আসেন। থালার পাশে শুকনা মরিচ পোড়া ও পেঁয়াজ। পেতলের ঘটিতে পানি রাখেন।

মুজিব, থালা নিয়ে মুখে গ্রাস দিয়েঃ চাচী, আপনার হাতের রান্নার কী যে স্বাদ।

আলেমা ভাসানীঃ তোমার আসার কথা হুজুরে তো কিছুই জানান নাই।

ভাসানীঃ আমিও তো জানি না যে মজিবর আসবে।

আলেমা ভাসানীঃ আপনি জানবেন না কেন? মিটিং দিলেই তো ও ছুটে আসে।

তেঘর মাদ্রাসা ময়দানে ভাসানী, মুজিব, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, সেলিনা বানুসহ অনেক নেতা মঞ্চে। সামনে অনেক কর্মী মাঠে হোগলায় বসা।

ভাসানী তোয়াহাকেঃ কীরে বামপন্থি নেতা? আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক করার জন্য তোমরা এত চাপ দিচ্ছে, কিন্তু কাউন্সিলরদের এ বিষয়ে রাজী করানোর জন্য ছোটাছুটি করার জন্য মুজিবর ছাড়া আর কাউকে পাই না।

তোয়াহাঃ উনি তো দলের সেক্রেটারি।

ভাসানীঃ পারবা এই দায়িত্ব সামলাতে? অলি আহাদ চায় সেক্রেটারি হতে। মাহমুদ আলী চায় এই পদ। মজিবরের দশ ভাগের এক ভাগ কাজ করে কেউ? আমি যদি কাউন্সিলে ভোট দিই, কেউ মজিবরের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে কয়টা ভোট পাবে?

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদঃ এই কথটা হুজুর একদম ঠিক বলেছেন।

বিশাল সমাবেশে সভাপতি ভাসানী।

ভাসানী: আওয়ামী লীগ কর্মীদের বলছি, পাকিস্তান তৈরি হয়েছিল মুসলমানদের জন্য। এখন এই দেশ মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান- সবার। আমাদের দলকেও সেভাবে গড়ে তুলতে হবে।

মুজিব: পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করতে হবে। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে আপস নাই। নৌবাহিনীর হেড কোয়ার্টার দিতে হবে চট্টগ্রামে। আর আমরা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাহলে রাজধানী কেন ঢাকায় হবে না?

মাঠে প্যাণ্ডেলের ভেতর মুজিবসহ অন্যরা মাটির থালায় খিচুড়ি খাচ্ছেন।

ভাসানী: আওয়ামী লীগ কৃষক-শ্রমিকের দল, এটা যেন কেউ না ভোলে। গরীব মানুষের সমর্থন না থাকলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মুসলিম লীগের পার্থক্য থাকবে না।

মুজিব: হুজুর, জয়পুরহাট মহকুমা শহর হলেও আসলে তো গ্রাম। জনসভায় এত লোক হাজির হয়েছে আপনার ডাকে। আওয়ামী লীগকে কেউ ঠেকায়ে রাখতে পারবে না।

ভাসানী: আমি তো দেখলাম, মানুষ তোমার বক্তৃতার সময়েই বেশি তালি দিয়েছে।  তুমি গরীব মানুষের মনের কথা বুঝাইয়া বলতে পার। আবার শিক্ষিত মানুষও বোঝে তোমাকে।

Place your advertisement here
Place your advertisement here