• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

Find us in facebook

বঙ্গবন্ধুর হাতেই স্বাস্থ্য খাতের পরিবর্তন

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৩১ আগস্ট ২০২০  

Find us in facebook

Find us in facebook

ডা. কনক কান্তি বড়ূয়া

ন্যায় প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্বে যিনি অদ্বিতীয়; যিনি অসহায়, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের মুক্তির দিশারি ও আশা-ভরসার স্থল; দেশপ্রেম, স্বাধীনতার স্বপ্ন যার মননে সার্বক্ষণিক আচ্ছাদিত; জীবন-যৌবন সর্বস্বই যার দেশের মানুষের জন্য উৎসর্গিত, দু'চোখে স্বপ্ন যার উন্নত সুখী, সমৃদ্ধ, কল্যাণকর, সকল নাগরিকের জন্য মর্যাদাপূর্ণ ও শান্তিপ্রিয় একটি নতুন দেশ প্রতিষ্ঠা করা এবং এমনই একটি বিশ্ব গড়ে তোলার স্বপ্নদ্রষ্টা এক মহান বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধুর কথা বলছি। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে অল্প দিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু উন্নয়নের পথে নিয়ে যান।

দেশের সব খাতের মতো স্বাস্থ্য খাতেও বঙ্গবন্ধুর অবদান অবিস্মরণীয়। স্বাস্থ্যকে সংবিধানের মূল অধিকারের অংশ হিসেবে সংযোজন, প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, চিকিৎসকদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রদান, বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ গঠনসহ বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে গবেষণার জন্য তৎকালীন আইপিজিএম অ্যান্ড আর-কে গবেষণা করার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন এবং এই হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৩০০ থেকে ৫০০ বেডে উন্নীত করেন।

দেশের মেডিকেল শিক্ষার ক্ষেত্রে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট এডুকেশন, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট এডুকেশন, সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল শিক্ষা ও গবেষণার প্রতিটি বিষয়ে জাতির পিতার অবদান রয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে মেডিকেল শিক্ষার ডিগ্রিগুলো ব্রিটিশ জেনারেল মেডিকেল কাউন্সিল একে একে স্বীকৃতি বাতিল করে দেয়। এর ফলে আমাদের দেশ থেকে ইংল্যান্ডে গ্র্যাজুয়েট, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষালাভের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। জাতির পিতা তখন অত্যন্ত দূরদৃষ্টি এবং প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে ১৯৭২ সালে একটা প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডারের মাধ্যমে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অব সার্জনস (বিসিপিএস) প্রতিষ্ঠা করেন। যারা পাকিস্তান থেকে এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেছেন, যারা বিদেশ থেকে এমআরসিপি, এফআরসিএস করেছেন, এ ধরনের ৫৪ জন ফেলো নিয়ে বিসিপিএস-এর যাত্রা শুরু।

স্বাধীনতা-উত্তর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ডা. আর জে গার্স্টকে আমন্ত্রণ জানান এবং অর্থোপেডিক সার্জারি বিষয়ে ট্রেনিংয়ের জন্য একটি টিমকে পূর্ব জার্মানি প্রেরণ করেন। উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়াসহ পঙ্গু হাসপাতালে অর্থোপেডিক সার্জারির ওপরে এমএস ডিগ্রি চালু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাছাড়া পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার ক্ষেত্রে আইপিজিএম অ্যান্ড আর-কে (বর্তমানে শাহবাগের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে শাহবাগে শিফট করা হয় তখন শয্যা সংখ্যা ছিল ৩০০টি। জাতির পিতা এটা আরও বাড়িয়ে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করেন। বঙ্গবন্ধু তখন আইপিজিএম অ্যান্ড আর-এর তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামকে বলেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য চিকিৎসকরা এত বেশি শাহাদাতবরণ করেছেন, আর কোনো পেশার লোক স্বাধীনতার জন্য এত বেশি শাহাদাতবরণ করেননি। প্রফেসর ইসলাম, আমি আপনাকে অনুরোধ করব যে সকল শিক্ষক, চিকিৎসক শাহাদাতবরণ করেছেন তাদের নাম লিখে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করুন। অধ্যাপক ইসলাম সেই মহতী কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন। ৮৯ জন চিকিৎসক দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছিলেন।

গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) বঙ্গবন্ধুর সময়েই প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালের শেষের দিকে দেশের ৭টি মেডিকেল কলেজের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজকে পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল কলেজে রূপান্তর করা হয়। অবশ্য এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল কলেজে রূপান্তরিত করার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদের তৎকালীন সহসভাপতি জাহিদুল হাসানের নেতৃত্বে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনসহ অন্যদের সঙ্গে আমিও মিছিল করেছিলাম এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, 'এক বছরও হয় নাই আমি দায়িত্ব গ্রহণ করেছি, এর মধ্যেই মিছিল করেছে, এরা কারা?' বঙ্গবন্ধু তখন তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাককে (মরহুম) দিয়ে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মালেক উকিলের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। পরবর্তী সময়ে তিন মাসের মধ্যে কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের একটি পরিত্যক্ত ভবনে বেসিক সায়েন্সে এমবিবিএস চালু হয়।

বঙ্গবন্ধু তখন একটা রেফারেল সিস্টেমের কথা বলেছিলেন। প্রতিটি গ্রাম বা ওয়ার্ডে একজন স্বাস্থ্যকর্মী থাকবেন। যে স্বাস্থ্যকর্মী প্রতিটি বাড়ি ঘুরে মানুষের স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নেবেন। অসুস্থ লোক থাকলে তাকে চিহ্নিত করে ইউনিয়ন সাব সেন্টারে নিয়ে যাবেন। সেই ইউনিয়ন সাব সেন্টারে একজন ডাক্তার থাকবেন, একজন নার্স থাকবেন, একজন প্যারামেডিক থাকবেন এবং সেখানে রোগীকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করতে না পারলে তাকে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠাবেন। থানা কমপ্লেক্সে রোগী সুস্থ না হলে তাকে মহকুমা হাসপাতাল বা জেলা হাসপাতালে বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হবে। জাতির পিতা বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে বিভিন্ন সাবজেক্ট, সাবস্টেশালিস্ট সাবজেক্ট পর্যন্ত চালু করেছেন। ১৯৭৩ সালে তিনি কার্ডিও ফিজিওলজি ল্যাব প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ১৯৭৮ সালে খুলনা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

বঙ্গবন্ধু শুধু দেশকে প্রতিষ্ঠা ও শত্রুমুক্ত করে যাননি; মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা- অন্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কতটা জনকল্যাণমুখী ছিলেন বর্তমান সময়েও আমরা তা ভেবে অবাক হয়ে যাই। বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা নিয়েই আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কমিউনিটি ক্লিনিক খুলেছেন। এ কারণেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করার চেষ্টা করছি। প্রকৃতপক্ষে, বঙ্গবন্ধুর পথ ধরেই জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের মেডিকেল শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। দেশে বর্তমানে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫টি, সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৩৮টি। এর মূলে রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার অবদান।

বর্তমানে যখন দেখি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের চিকিৎসকরা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য অধ্যয়ন করছেন, চিকিৎসাসেবা প্রদান করছেন, শিক্ষাদান করছেন তখন বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা খুবই মনে পড়ে। দেশের মেডিকেল শিক্ষার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান চিরস্মরণীয় ও অনস্বীকার্য। জাতির পিতা ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে জেল খেটেছেন। আমরা জাতির পিতার ত্যাগকে একটু অনুধাবন করে চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণাকে যেন আরও গুরুত্ব দিই; সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকদের অন্যান্য মহতী কর্মগুলোও যেন নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করি।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র: দৈনিক সমকাল।

Place your advertisement here
Place your advertisement here