• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

Find us in facebook

বঙ্গবন্ধুর দর্শন: নারীর ক্ষমতায়ন

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৭ অক্টোবর ২০২০  

Find us in facebook

Find us in facebook

রঞ্জন কর্মকার

নারী-পুরুষের সমতা, সমসুযোগ, সমমর্যাদাবোধ ও উন্নয়ন একটি দেশের তথা জাতির উন্নয়নের পূর্বশর্ত। বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক সংখ্যকই নারী। সুদীর্ঘকাল ধরে বিশেষ করে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক, অসম অধিকার ও বৈষম্যের কারণে নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে আছে। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালি হত্যা ও কয়েক লাখ নারীর নির্যাতনের শিকার হওয়ার মধ্য দিয়ে এদেশ স্বাধীন হয়। বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা, এদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রপথিক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র ছিল শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এ পথ বেয়েই আজকে নারীর ক্ষমতায়নের পথ সুগম হয়েছে।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে অন্যান্য আর্থ-সামাজিক বিষয়ের পাশাপাশি নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ অগ্রযাত্রার সূচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে। তিনি বিশ্বাস করতেন, নারীর ভিতরকার শক্তি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য বড় হাতিয়ার। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস সময়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর শান্তি কমিটি ও রাজাকার-আলবদর-আলশামসের সহযোগিতায় সারাদেশে রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী; সর্বোপরি নারীদের ওপর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ও জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ও বর্বর নির্যাতন চালিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে নির্যাতনের শিকার এসব নারী ও তাদের সন্তানদের পরিবার ও সমাজে ফিরে যাওয়া নিয়ে সমস্যার শুরু হয়। রক্ষণশীল সমাজের অনেকেই, এমনকি নিজ পিতা-মাতা ও পরিবারও এদেরকে মেনে নিতে পারছিল না। তখন বঙ্গবন্ধু ‘বীরাঙ্গনা’ আখ্যা দিয়ে তাদের পিতার নামের জায়গায় নিজের নাম এবং ঠিকানার জায়গায় তার বাড়ির ঠিকানা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর লিখতে বলেন। এভাবেই সব হারানো অসহায় এসব নারীর পাশে দাঁড়ান তিনি। তাদের হারানো সামাজিক মর্যাদা, স্বীকৃতি ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেন। বেশ কয়েকজন নারীর জন্য যৌতুকবিহীন বিয়ের ব্যবস্থা করেন। যুদ্ধশিশুদের বিদেশে দত্তক হিসেবে পাঠানোর জন্য আইন তৈরি করেন। ক্ষতিগ্রস্ত নারী-শিশুদের আশ্রয় ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী-কন্যাদের জন্য তিনি নারী আশ্রয়কেন্দ্র চালু করেন। শহীদ পরিবারের জন্য ভাতা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন।

বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর শাসনকালের প্রথম থেকেই নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। যার লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমঅধিকার, সমমর্যাদা ও সমঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী নবগঠিত সরকারের আমলেই রচিত হয় আমাদের জাতীয় সংবিধান, যার বিভিন্ন ধারার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় নীতি ও কাঠামোতে নারী-পুরুষ সাম্য, সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংবিধানে ঘোষণা করা হয়- দেশের সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন। রাজনীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণের স্বার্থে এ সংবিধানে জাতীয় সংসদে বিশেষ বা সংরক্ষিত নারী আসনের বিধান চালু করা হয়। নারীদের জন্য পৃথক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরিতে পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও একটি স্বাধীন দেশের অবকাঠামো বিনির্মাণ এবং সমাজ উন্নয়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার, সহিংসতা রোধসহ যা যা প্রয়োজন, তার সবকিছুরই সূচনা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। নারীদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ও জীবনদর্শনের প্রতিফলন পাওয়া যায় তাঁর বক্তৃতা-বিবৃতিতে। তিনি বলেছিলেন- ‘নারীদেরও পুরুষদের মতো সমান অধিকার রয়েছে এবং তা রাজনীতির ক্ষেত্রেও। আওয়ামী লীগ যেমন অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে, তেমনি নর-নারীর সমান অধিকারেও বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগেও নারী নেতৃত্ব গড়ে তোলা দরকার।’ তিনি এটা শুধু কথার কথা হিসেবেই বলেননি; মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করতেন এবং নিজ দল ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এই নীতির বাস্তবায়ন করেছিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর দলের নেতৃত্বের হাল যারা ধরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সামনের সারিতে ছিলেন জোহরা তাজউদ্দীন ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে এসে দলকে পুনরুজ্জীবিত করতে অবদান রাখেন। ‘৭৫-এর পর দীর্ঘ ২১ বছর ক্ষমতা থেকে দূরে ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সেই সময়ে অগণতান্ত্রিক সেনাশাসক ও স্বৈরশাসকের শাসন-শোষণে পিষ্ট হয়েছিল বাংলার মানুষ। দীর্ঘদিন রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের সেইসব উত্তাল দিনে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি অনেক নারী ও মানবাধিকার সংগঠনের জন্ম ও উত্থান ঘটে। তৈরি হয় অনেক নারী নেতৃত্ব যারা সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি স্বৈরাচার তথা রাজনৈতিক আন্দোলনেও অংশ নিয়েছেন। পাশাপাশি আশির দশকে বাংলাদেশে অনেক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পথচলা শুরু হয়। রাজপথে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে পরিণত রাজনীতিবিদে রূপান্তরিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসে প্রতিটি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর দর্শন, চিন্তা ও স্বপ্ন সামনে রেখে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। তাঁর আমলে মন্ত্রিসভায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। নারী নেতৃত্বের বিকাশে তিনি স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পরিষদে সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোটে নারীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিধান চালু করেন। এর মাধ্যমে তৃণমূলে নারী রাজনীতিবিদদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।

২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দপ্তরে নারী মন্ত্রী নিয়োগ দেন। প্রশাসনেও নারীদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করেন। শ্রমজীবী নারীদের নেতৃত্বে আনার জন্য বিশেষ উদ্যোগও লক্ষ্য করা যায়। বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম, সবাইকে কাছে টেনে নেওয়ার ক্ষমতা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা ও বাঙালি জাতির প্রতি ভালোবাসার উত্তরাধিকার বহন করে এ দেশকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বর্তমান সময়ে শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের সফল ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনায়কদের অন্যতম। তার নেতৃত্বে ভিশন বা রূপকল্প ২০২১-এর বাস্তবায়ন এখন শেষের পথে, যার মাধ্যমে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরির রূপরেখা প্রকাশ করা হয়েছিল। এ পর্যায়ে এখন ২০৪১ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার জন্য পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে। মানবউন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের উন্নতি ঈর্ষণীয়। এর নেপথ্যে রয়েছে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের উঠে আসার ঘটনা। নারীরা শুধু ঘরের ভেতরে আটকা পড়ে থাকলে পরিবার ও দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এটা উপলব্ধি করে গত বেশ কয়েক বছর ধরেই সরকার নারীবান্ধব বিভিন্ন উদ্যোগ ও উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে।

লেখক: মহাসচিব, ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন।

Place your advertisement here
Place your advertisement here