• মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১০ ১৪৩১

  • || ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook
সর্বশেষ:
যুদ্ধের অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যয় হলে বিশ্ব রক্ষা পেত- প্রধানমন্ত্রী দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড মেডিকেল কলেজের ক্লাস অনলাইনে নেয়ার নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ‘গণতান্ত্রিক রীতিনীতি না মানলে জনগণই বিএনপিকে প্রতিহত করবে’ লালমনিরহাটে হত্যা মামলায় বিএনপির দুই নেতা কারাগারে

চীনা অর্থায়নে তিস্তা প্রজেক্ট: উত্তরবঙ্গের মানুষের ভাগ্য বদলে দেব

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২ সেপ্টেম্বর ২০২০  

Find us in facebook

Find us in facebook

মোবায়েদুর রহমান

ভারত তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যা ৩০ বছরেরও বেশি সময় ঝুলিয়ে রাখায় এবার বাংলাদেশ ভারতের সাহায্য ছাড়াই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশ ‘তিস্তা রিভার কম্প্রিহেন্সিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশেন’ প্রজেক্ট নামক একটি প্রকল্প প্রণয়ন করেছে। এই প্রজেক্ট নিয়ে ভারতের অসন্তুষ্টি সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রজেক্টের অর্থায়নের জন্য গণচীনের সাথে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। 

এই প্রজেক্টের প্রাক্কলিত ব্যায় ধরা হয়েছে ৯৮৩.২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ এক বিলিয়নের কাছাকাছি। বাংলাদেশি মুদ্রায় খরচ পড়বে প্রায় ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। চীন প্রাথমিকভাবে সমগ্র অর্থায়নে রাজি হয়েছে। এখন প্রকল্পটির খুঁটিনাটি নিয়ে দুই দেশের বিশ্লেষকদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে চীনের অর্থায়ন সুনিশ্চিত হয়ে যাবে বলে বাংলাদেশ পক্ষের বিশ্বাস। সে ক্ষেত্রে আগামী বছরের শুরু থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা হবে বলে বাংলাদেশ আশাবাদী।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রের প্রকাশ, প্রজেক্টটির সম্ভাব্যতা পর্যালোচনা বা ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন হয়েছে ২০১৯ সালে। তিস্তা নদী থেকে ভারত শুষ্ক মৌসুমে বিপুল পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করে। ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় শীতকালে সেচ কাজ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কৃষি ফসল উৎপাদন দারুণভাবে বিঘিœত হয়। পক্ষান্তরে বর্ষা মৌসুমে ভারতীয় বাঁধের সুইসগেইট খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ পানিতে সয়লাব হয়ে যায়।

আজিজ মোহাম্মদ চৌধুরী সম্ভাব্যতা স্টাডির পরিচালক। তিনি একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিনিধিকে জানান যে, গত সপ্তাহে চীনা পক্ষ এই প্রকল্পের গুরুত্ব জানতে চায়। বাংলাদেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির ওপর প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের যে কি সীমাহীন গুরুত্ব সেটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। চীনা পক্ষ বাংলাদেশের জবাবে সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

আলোচ্য সূত্রে বলা হয় যে, গত জুন মাসে বাংলাদেশ চীনের কাছে অর্থায়নের অনুরোধ করে। এরপর শুরু হয় দুই পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা। বাংলাদেশের পক্ষে আলোচনা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আর চীনা পক্ষ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মধ্যে চলমান আলোচনায় মধ্যস্থতা করছে অর্থমন্ত্রণালয়ের অধীন বহিঃ সম্পদ বিভাগ (ইআরডি)। ইআরডি’র এশীয় শাখা প্রধান শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকি জানিয়েছেন যে, পাউবো যে সব কাগজপত্র দিয়েছে সেগুলো সব চীন সরকারের নিকট ফরোয়ার্ড করা হয়েছে। এ ব্যাপারে চীন কিছু ব্যাখ্যা চেয়েছিল। সেগুলো তাদেরকে দেওয়া হয়েছে।

দুই
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, তিস্তা নদীর পানি সমস্যা অনেক পুরাতন। ডিসেম্বর থেকে মে মাস- এই ৬ মাসকে শুষ্ক মৌসুম ধরা হয়। এই সময় বাংলাদেশ তিস্তার পানির শতকরা ৫০ ভাগ দাবি করে আসছে। ভারত বাংলাদেশের এই দাবি মেনে নেয়। ২০১১ সালে ড. মনমোহন সিং যখন কংগ্রেস থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন ৫০ঃ৫০ হিস্যার ভিত্তিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরকালে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী রাজী নন, এই অজুহাত তুলে একেবারে শেষ মুহূর্তে ভারত চুক্তি স্বাক্ষর থেকে বিরত থাকে। বাংলাদেশের কথা হলো, এটি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং একটি প্রাদেশিক সরকারের মধ্যকার বিষয়। প্রাদেশিক সরকারকে রাজী করানোর দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। তাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধের জন্য বাংলাদেশ দুর্ভোগ পোহাবে কেন?

ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ‘দি হিন্দু’র বরাত দিয়ে ঢাকার আলোচ্য ইংরেজি দৈনিকটি রিপোর্ট করেছে যে, তিস্তা প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ এবং চীনের মধ্যকার আলাপ আলোচনা ভারতকে উদ্বিগ্ন করেছে। তাদের রিপোর্ট মতে, যেহেতু বাংলাদেশ ও চীনের ঋণ চুক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ভারত বাংলাদেশের একটি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, তাই ভারত গত ১৮-১৯ তারিখে করোনা মহামারীর মধ্যেও তড়িঘড়ি করে দেড় দিনের এক অনির্ধারিত সফরে তাদের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধণ শ্রিংলাকে ঢাকা পাঠায়। হিন্দুর ঐ রিপোর্টে বলা হয় যে, তিস্তা প্রজেক্ট নিয়ে ঢাকা- বেইজিং আলোচনা ঢাকা-দিল্লী সম্পর্কের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলবে। কারণ এর ফলে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন সম্পর্কে ঢাকা-দিল্লীর আলাপ-আলোচনা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।

যেহেতু দশকের পর দশক ধরে ভারত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সমস্যাকে ঝুলিয়ে রেখেছে, তাই পানি উন্নয়ন বোর্ড চীনের পাওয়ার কন্সট্রাকশন বোর্ডকে ‘তিস্তা রিভার কম্প্রিহেন্সিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্ট্রোরেশনে’র ওপর একটি সম্ভাব্যতা স্টাডি পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। চীনা প্রতিষ্ঠান ‘পাওয়ার চায়না’ যে ফিজিবিলিটি রিপোর্ট দেয়, সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি প্রাথমিক উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করে। এই প্রাথমিক পরিকল্পনার উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে: রংপুরের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন। এজন্য তিস্তা নদীর উভয় পাশে গ্রোথ পয়েন্ট নির্মাণ। এসব গ্রোথ পয়েন্ট তিস্তায় বন্যা নিরোধ করবে এবং নদীর তলদেশ থেকে পলিমাটি অপসারণ এবং নতুন করে পলিমাটি জমা বন্ধ করবে।

তিন
তিস্তা নদী উৎসারিত হয়েছে ভারতের সিকিম রাজ্য থেকে এবং লালমনিরহাট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীটি বাংলাদেশের রংপুর, নীলফামারি, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম হয়ে ফুলছড়ি ঘাটে এসে যমুনা নদীতে মিশে গেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রাথমিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় বলা হয়েছে যে, বন্যার সময় প্রতি সেকেন্ডে তিস্তায় ৪৫০০ কিউবিক মিটার পলি জমে। এছাড়া বন্যার ভয়াবহতা তো রয়েছেই। ঐ পরিকল্পনায় আরও বলা হয়েছে যে, এই প্রকল্পে যে অর্থ ব্যয় হবে তার চেয়ে বেনিফিট বা উপকার হবে তিনগুণ বেশি। দারিদ্র্যপ্রবণ এই অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য দূর হবে। বর্ষায় পানি ছেড়ে দিয়ে ভারত এই অঞ্চলে যে বন্যার সৃষ্টি করে সেই বন্যাকে রুখে দেবে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত প্রকল্প। ফলে তিস্তা পাড়ের মানুষের জীবন পদ্ধতি বদলে যাবে।

১৯৯৬ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় তিস্তামুখে ভারত একটি বাঁধ নির্মাণ করে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত গজলডোবা বাঁধের ৫০টি ফ্লাড গেট খুলে দেয়। ফলে ভারত সৃষ্ট বন্যায় তিস্তা পাড় প্লাবিত হয়।

যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মাহমুদুর রহমান বলেন যে, ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভারত তিস্তায় দুই ডজন স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এসব স্থাপনার মাধ্যমে তিস্তার বিপুল পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এছাড়া তিস্তার সিকিম অংশে অনেকগুলো স্ট্রাকচার নির্মাণ করা হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ভারতেরই দুইটি প্রদেশ, অর্থাৎ সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গেই তিস্তার পানির সিংহভাগ প্রত্যহার করা হচ্ছে। এরপর যৎসামান্য পানি অবশিষ্ট থাকে সে টুকুই বাংলাদেশে আসছে।

চার
তিস্তার যেটুকু পানি বাংলাদেশ অংশে আসছে সেটুকু প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়। তাই চীনা অর্থসহায়তায় বাংলাদেশ যে তিস্তা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সেটি উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবন জীবিকার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভারতীয় বিরোধিতা অতিক্রম করে সরকার এগিয়ে যেতে পারবে কি?

আমার মনে হয় পারবে। কারণ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে উত্তরবঙ্গের মানুষ তো বটেই, বাংলাদেশের মানুষ জাতীয় স্বার্থে এই প্রজেক্ট বাস্তবায়নের পেছনে দাঁড়াবে। একটি সরকারের আসল শক্তি হলো জনগণ। তিস্তার ব্যাপারে সব মানুষ ঐক্যবদ্ধ থাকবে। আর ভারত বাগড়া দেবে কোন মুখে? তারা বাগড়া দিতে এলে বাংলাদেশের পরিষ্কার জবাব হবে , তোমরা আমাদেরকে তিস্তার পানির ৫০ শতাংশ হিস্যা দাও, তাহলে আমাদের কোনো কথা থাকবে না। কিন্তু তোমরা পানিও দেবে না, অবার আমরা কিছু করতে গেলে তোমরা বাধা দেবে, সেটা তো হতে পারে না।

লেখক: সাংবাদিক।
[email protected]

সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব।

Place your advertisement here
Place your advertisement here