• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

Find us in facebook

কম খরচে বিদেশ ভ্রমণের চেষ্টা করি সব সময়: নাজমুন নাহার

দৈনিক রংপুর

প্রকাশিত: ২১ নভেম্বর ২০১৮  

Find us in facebook

Find us in facebook

শখের বসে অনেকেই ঘুরে বেড়ান দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এই শখের পরিধি বেড়ে কখনো বিদেশ পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরতে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ান- এমন পর্যটকের সংখ্যা খুবই কম! এই কম সংখ্যকদের মধ্যে একজন নাজমুন নাহার। দেশের পতাকা হাতে ঘুরে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর ১১১টি দেশ।

নাজমুন নাহারের জন্ম লক্ষীপুর জেলায় হলেও ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির কথা তুলে ধরেছেন বিশ্বব্যাপী।

বাংলাদেশের পতাকা হাতে এ নারীর বিশ্বজয়ের যাত্রা চলছে দুর্বার গতিতে। তার স্বপ্ন পুরো পৃথিবীকে বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করা। পৃথিবীর এক দেশ থেকে অন্যদেশে ছুটে চলা, নানান দেশের মানুষের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা, অজানাকে জানার ইচ্ছেই তাকে দিয়েছে জীবনের দর্শন।

 

1.কম খরচে বিদেশ ভ্রমণের চেষ্টা করি সব সময়: নাজমুন নাহার

সম্প্রতি ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশি এই নারী পরিব্রাজকের সঙ্গে। তিনি যখন দৈনিক রংপুর -এর মুখোমুখি হন তখন তার অবস্থান ছিল আটলান্টিক মহাসাগরে। সেখান থেকেই বিদেশ ভ্রমণের নানা বিষয় নিয়ে কথা হয় দৈনিক রংপুর -এর নিজস্ব প্রতিবেদক সঙ্গে।

প্রশ্ন: আপনি কেমন আছেন?

উত্তর: ভালো

প্রশ্ন: এখন কোথায় অবস্থান করছেন?

উত্তর: পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়াতে আছি এখন। ১১১তম দেশ হিসেবে এখানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলাম।

প্রশ্ন: এরপরের পরিকল্পনা কি?

উত্তর: মৌরিতানিয়ার রাজধানী নৌআকচট থেকে বাই রোডে যাত্রা করবো সেনেগাল, গাম্বিয়া, গিনি। সেখান থেকে পশ্চিম আটলান্টিকের পাশ ঘেঁষে যাওয়া দেশগুলো থেকে উত্তর আটলান্টিকের দেশগুলো পর্যন্ত যাত্রা অব্যাহত থাকবে!

 

3.কম খরচে বিদেশ ভ্রমণের চেষ্টা করি সব সময়: নাজমুন নাহার

প্রশ্ন: বিশ্ব ভ্রমণের ম্যাজিক্যাল সংখ্যা একশ এগারোতম দেশে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানোর মুহূর্তে আপনার অনুভূতি কেমন ছিলো?

উত্তর: দারুণ এক অনুভূতি, যা বলে বা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে ১১১টি দেশে ঘুরেছি, এরচেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে। আমি এই পতাকা নিয়ে সারাবিশ্ব ঘুরবো। সারাবিশ্বের মানুষের কাছে আমার দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরবো।

প্রশ্ন: আপনার ভ্রমণের শুরুর গল্পটা শুনতে চাই?

উত্তর: রাজশাহী বিশবিদ্যালয়ে পড়ার সময় ২০০০ সালে প্রথম বাংলাদেশের বাইরে ভ্রমণ শুরু। ইন্ডিয়ার পাঁচমারিতে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রামে যোগ দেয়ার জন্য! সেখানে আমি বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করেছিলাম পৃথিবীর ৮০টি দেশের গার্লস গাইড ও স্কাউটসের সঙ্গে। এরপর থেকেই আমার বিশ্বভ্রমণের যাত্রা শুরু।

 

4.কম খরচে বিদেশ ভ্রমণের চেষ্টা করি সব সময়: নাজমুন নাহার

তবে ছোটবেলায় আমি আমার বাবার কাছে দেশ-বিদেশের অনেক ভ্রমণকাহিনি শুনতাম। এছাড়া সেসময় প্রচুর গল্পের বই পড়তাম। আমি মাসুদ রানার বই পড়তাম, সেই বইগুলো পড়ে ভ্রমণ নিয়ে আমার দুর্বলতা বাড়তে থাকে। সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবির দেশে কবিতার দেশে, জ্যাক কেরুয়াকের অন দ্য রোড, এরিক উইনারের দ্য জিওগ্রাফি অব ব্লিস, সুজানা রবার্টসের অলমোস্ট সাম হয়ার, দ্বারুচিনি দ্বীপের গল্প আমার এখনো মনে পড়ে। বইগুলো পড়ার সময় আমি গল্পের মধ্যে ডুবে যেতাম। তখন আমার মনে হতো আমি ব্যাগ নিয়ে জঙ্গলে ঘুরছি কিংবা কোনো হিংস্র প্রাণীর মুখোমুখি হচ্ছি! আর বইপড়া শেষে বলতাম, ইশ! আমি যদি যেতে পারতাম। এসব বই থেকেই মূলত আমি অনুপ্রাণিত হই।

প্রশ্ন: এই পর্যায়ে আসতে আপনাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। সেই গল্পটা কি বলা যাবে?

উত্তর: এতটা দেশ ঘুরে ফেললাম, এটা মনে পড়লেই আমার ভেতরে একটা শিহরণ জাগে। আমি যখন বৃত্তি নিয়ে চলে যাই সুইডেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। সেখানে পড়ার পাশাপাশি বিশ্ব-ভ্রমণের লক্ষ্যে অর্থ সঞ্চয় করেছি। আমার মনে আছে, রাতে ৩-৪ ঘণ্টার বেশি ঘুমাইনি। ভোরে উঠে ক্লাসে গিয়েছি। ক্লাস শেষে কাজ করে এসে রান্না করেছি। তারপর খেয়ে গভীর রাত পর্যন্ত প্রেজেন্টেশন রেডি করেছি। আবার পরেরদিন ভোরে বের হয়েছি। জীবনের এই অংশটা খুব কষ্টকর ছিল, তবুও আমি উপভোগ করেছি। আনন্দ নিয়ে পরিশ্রম করেছি। কারণ আমি জানি, জীবনের ইচ্ছে পূরণ করতে হলে আমাকে পরিশ্রম করতেই হবে। আমি জানতাম কষ্ট করে উপার্জন না করলে আমি ভ্রমণ করতে পারবো না। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে আমি ১৭/১৮ ঘণ্টা কাজ করেছি। কারণ আমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে পুরো পৃথিবী ভ্রমণ করা, এই দেশের সংস্কৃতিকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা। তবে ইউরোপে থাকার কারণেও আমার এই ভ্রমণে কিছুটা সুবিধা হয়েছে।

 

5.কম খরচে বিদেশ ভ্রমণের চেষ্টা করি সব সময়: নাজমুন নাহার

প্রশ্ন: বাংলাদেশের কোনো পুরুষ এখন পর্যন্ত বিশ্ব ভ্রমণের সাহস করেনি, কিন্তু আপনি নারী হয়ে কিভাবে করলেন! এই প্রশ্নটা নিশ্চই আপনাকে বহুবার শুনতে হয়েছে। আপনি সেই উত্তরটা কিভাবে দেন?

উত্তর: এটা আমার একটি মানসিক সংগ্রাম। কোথাও বের হলেই নিজের ভেতরে আমি সাহস রাখি। আমি পারবো-এই কথাটা সবসময় মাথায় রাখি। এই সাহসের জন্যেই আমার কোন অসুবিধা হয়নি। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমি ইয়ুথ হোস্টেলেও ছিলাম। কিন্তু কখনোই কোন অসুবিধা হয়নি। নিজেকে কীভাবে আরেকজনের সামনে তুলে ধরবো সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন: এতগুলো দেশ ঘুরেছেন। খুব ভয় পাওয়ার মতো কোন ঘটনা কী ঘটেছে?

 

6.কম খরচে বিদেশ ভ্রমণের চেষ্টা করি সব সময়: নাজমুন নাহার

উত্তর: অনেক ঘটেছে। তবে সর্বশেষ ঘটনার বর্ণনা দেই। প্যারিস থেকে আসা ভিক্টর নামে এক মেয়ের সঙ্গে রওনা দিলাম মেস্তিয়া টাউনের উদ্দেশ্যে, চার ঘণ্টার পাহাড়ি পথ। গাড়ি একটু পর পরই বাঁক নিচ্ছিলো পাহাড়ি রাস্তা। আমার খুব অপূর্ব লাগছিলো। চারপাশের চমৎকার দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা যাচ্ছিলাম! হটাৎ মিনি বাসটি এসে থামলো জটলা বাঁধা অনেক গুলো মানুষের সামনে, তাদের সবার হাতে লাঠি। গ্রামটির নাম সম্ভবত লেশগুয়ানি। এই পরিস্থিতিতে সবাই একটু হতচকিয়ে উঠলো। আমাদের মিনিবাসের সবাই টুরিস্ট। আমি জানালা দিয়ে সামনের দিকে তাকালাম, গ্রামবাসী সবাই রাস্তায়। সবায় বিক্ষোভমুখি বজ্রকণ্ঠ। রাস্তায় বড় বড় পাথর ফেলানো, ওরা রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে এক সপ্তাহের জন্য! গ্রামবাসীর কিছু দাবি দাওয়া আছে তা মেনে নিতে হবে, না হয় তারা কাউকেই ছাড়বে না। একটু পরই দেখলাম বিশাল পুলিশ বাহিনী এলো বন্দুক তাক করতে করতে। লাইন ধরে তারা বন্দুক তাক করে ব্যারিকেডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি বিপদের অশনি সংকেত টের পেলাম। মনে হলো আমাদের সবাইকেই মরতে হবে। দেখতে পাচ্ছি পুলিশের দিকে লক্ষ্য করে জনগণ ইট পাথর ছুঁড়ছে। এখনই হয়তো কয়েকটা লাশ পড়ে যেতে পারে, গ্রামবাসী উত্তাল। তৎক্ষণাৎ আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম বাইরে। কেউ গাছের পেছনে, কেউ জঙ্গলে, কেউ গ্রামের বাড়ির পেছনে লুকাতে থাকলাম। ভিক্টর আমাকে বার বার বলছিলো, ভয় পেয়ো না! ভিক্টরকে বললাম, আমি ভয় পাই না। তবে অক্ষত ভাবে বাঁচতে চাই, আমাকে দেশের পতাকা হাতে বিশ্বভ্রমণ শেষ করতে হবে। আমি অনেক বড় দায়িত্ব আর চ্যালেঞ্জ নিয়েছি, তা আমাকে শেষ করতে হবে। আরো কত কত পাহাড়ে আমি যাবো, স্রষ্টার কত সুন্দর প্রকৃতি এখনো দেখার বাকি আছে তা দেখবো। তবে সৌভাগ্য শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে ফিরে আসতে পেরেছিলাম।

 

7.কম খরচে বিদেশ ভ্রমণের চেষ্টা করি সব সময়: নাজমুন নাহার

প্রশ্ন: দৈনিক রংপুর -এর পাঠকদের জন্য পয়সা বাঁচিয়ে কিভাবে ভ্রমণ করা যায়, তার একটা টিপস দেবেন?

উত্তর: অবশ্যই। আমি কোটিপতির মেয়ে নই। আমার বাবা মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু আমি আত্মনির্ভরশীল হতে চেয়েছি। যেহেতু আমার অনেক টাকা নেই, কিন্তু যেতে হবে অনেক জায়গায় সেহেতু পয়সা বাঁচিয়ে ভ্রমণ করার চেষ্টা করি সবসময়। আমি বিশ্বাস করি, বিশ্বভ্রমণের জন্য কোটি কোটি টাকা থাকার প্রয়োজন নেই। একটু পরিশ্রম করলেই সম্ভব।

 

8.কম খরচে বিদেশ ভ্রমণের চেষ্টা করি সব সময়: নাজমুন নাহার

আপনারা ভ্রমণে যাওয়ার দুই তিনমাস আগে টিকেট করে রাখবেন। তাহলে দেখবেন খরচ অনেক কম পড়বে। বাই রোডে ট্রাভেল করার চেষ্টা করবেন। যেখানে যাবেন তার আশপাশে দেখার মতো আর কী কী আছে অনলাইন থেকে জেনে নেবেন। একটি দেশ দেখার পর বাইরোডে আশপাশের অন্যান্য দেশ দেখবেন। চিপ রেটের ফ্লাইটগুলোর খোঁজ নেবেন। কোন শহরে ফ্লাই করলে খরচ কম হবে এগুলো রিসার্চ করে বের করবেন।

থাকার বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই ইয়ুথ হোস্টেলে থাকবেন। ইয়ুথ হোস্টেলের সুবিধা হলো আপনার মতো অনেক ট্রাভেলারের সঙ্গে দেখা হবে। ইয়ুথ হোস্টেলে আমেরিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মতো জায়গায় এক থেকে দেড় হাজার বাংলাদেশি টাকায় রাত থেকেছি আমি। ধরুন আপনি নর্থ অস্ট্রেলিয়া যাবেন। নেটে চিপ রেট ইয়ুথ হোস্টেল ইন নর্থ অস্ট্রেলিয়া লিখে সার্চ দিলেই সব চলে আসবে। ডাউন-টাউনে থাকবেন। তাহলে সিকিউরিটি পাবেন। ট্রেন বা বাস পাবেন হাতের কাছেই।

 

9.কম খরচে বিদেশ ভ্রমণের চেষ্টা করি সব সময়: নাজমুন নাহার

প্রশ্ন: আপনাকে ধন্যবাদ।

উত্তর: দৈনিক রংপুরের পাঠকদের জন্য শুভ কামনা।

Place your advertisement here
Place your advertisement here