• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

Find us in facebook

আধুনিক ছাপাখানার ইতিহাস

দৈনিক রংপুর

প্রকাশিত: ১৫ নভেম্বর ২০১৮  

Find us in facebook

Find us in facebook

মানব সভ্যতায় বইয়ের ইতিহাস প্রায় ৩ হাজার বছর পুরানো হলেও পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত সেসব বই ছিল হাতে লেখা। বই ছাপার কিছু প্রাচীন ধারণার সন্ধান চীনে পাওয়া গেলেও সেসব বইয়ের সঙ্গে আধুনিক বই ছাপানোর পদ্ধতিতে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। সব মিলিয়ে বই ছিল তখন অত্যন্ত মূল্যবান, যে কারণে বেশিরভাগ বই গির্জা, রাজার তহবিল ও এই ধরণের অত্যন্ত শক্তিশালী ও ধনী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রয় করত। এছাড়া অল্প সংখ্যক বই শিক্ষিত ও অত্যন্ত ধনী ব্যক্তিগণ ক্রয় করতেন। পরবর্তীতে জার্মান অবিষ্কারক জোহানেস গুটেনবার্গ আধুনিক ছাপাখানার আবিষ্কার করলে অতি দ্রুতই তা পুরো জার্মানীসহ ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, হল্যান্ড এবং ইউরোপের অন্যান্য বেশ কিছু অঞ্চলে পৌঁছে যায়।

 

1.আধুনিক ছাপাখানার ইতিহাস

আধুনিক ছাপাখানার পূর্বের অবস্থা

বর্তমান যুগের আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে বড় নিয়ামক মানা হয় গুটেনবার্গের এই আধুনিক ছাপাখানার আবিষ্কারকে। গুটেনবার্গের ছাপাখানা আবিষ্কার না হলে আধুনিক সভ্যতার কোনো উপকরণই বাস্তবায়ন সম্ভব হত না। ছাপাখানা আবিষ্কার হওয়ায় ও পরবর্তীতে এই আবিষ্কার ছড়িয়ে পড়ায় বইয়ের দাম জনসাধারণের নাগালে আসে। ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষার আলো। এরই হাত ধরে ইউরোপে রেনেসাঁ, যান্ত্রিক সভ্যতার, পাশ্চাত্য দর্শন ও রাষ্ট্র পরিচালনার ধারণা ছড়িয়ে পড়ে ও পায় নতুন মাত্রা। জোহানেস গুটেনবার্গের আধুনিক ছাপাখানা আবিষ্কারের পূর্বে এসকল ধারণা ছড়িয়ে পড়া ছিল অকল্পনীয় একটি ব্যাপার।

 

2.আধুনিক ছাপাখানার ইতিহাস

চীনে অবশ্য প্রাচীন পন্থী বই ছাপানোর পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়। ইতিহাস মতে, ৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন বইটি ছাপানো বই হয়েছিল। “হীরক সূত্র” নামের সেই বইটি ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের একটি পবিত্র গ্রন্থ। হীরক সূত্র ছিল ১৭ ফুট লম্বা স্ক্রোল এবং তা বর্তমান যুগের বইয়ের মত করে বাঁধানো পদ্ধতির ছিল। এই বইয়ের অক্ষরগুলো বাঁকানো কাঠের হরফে কালির ছাপ দিয়ে লেখা ছিল। ওয়াং ঝাই নামের এক চীনা এই বই ছাপানোর কারিগর এবং এই পদ্ধরির আবিষ্কারক। যদিও কেনো বা কী থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা জানা যায় না। বর্তমানে বইটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে। ৯৩২ খ্রিষ্ট পর্যন্ত চীনে একই পদ্ধতিতে বই ছাপানো হতে থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, কাঠের অক্ষরগুলো একবার ক্ষয়ে গেলে সেগুলো ছাপানোর অযোগ্য হয়ে পড়ত এবং কাঠের অক্ষরগুলো তৈরি ছিল ব্যয়বহুল ও অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। এ কারণে কাঠের পরিবর্তে সে জায়গা দখল করে নেয় মাটির অক্ষর।

 

3.আধুনিক ছাপাখানার ইতিহাস

আধুনিক ছাপাখানার যাত্রা

পেশায় স্বর্ণকার জোহানেস গুটেনবার্গের আধুনিক ছাপাখানা আবিষ্কারের কারণ ঠিকমত জানা যায় না। তিনি কেন এ কাজে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, সে ব্যাপারে নানা মতামত প্রচলিত আছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, এই ধরণের কিছু আবিষ্কারের তাগিদ তার মাঝে হঠাৎ করেই উদয় হয়। যদিও কোনো কারণ বা মতামতই প্রমাণিত নয়। স্বর্ণকার হলেও গুটেনবার্গ লেখাপড়ায় প্রচুর সময় ব্যয় করতেন। তিনি যন্ত্রবিজ্ঞানে আগ্রহী ছিলেন এবং নিত্য নতুন খুঁটিনাটি আবিষ্কার করে যেতেন। কারণ না জানা গেলেও ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, গুটেনবার্গ প্রথম ১৪৩৯ সালে আধুনিক ছাপাখানার আবিষ্কারের বিষয়ে ভাবতে শুরু করেন। ১৪৪০ সালের দিকে তিনি বাস করতেন স্ট্র্যাসবার্গ নামক স্থানে। সেখানে তিনি নিজস্ব কর্মশালা গড়ে তোলেন যেখানে রাতদিন এই ছাপাখানার কাজ চলত।

 

4.আধুনিক ছাপাখানার ইতিহাস

অবশ্য এর আগে তার চৈনিক কাঠ ও মাটির অক্ষরে ছাপানো সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে হয়। এরপর তিনি বিভিন্ন পুরানো কৌশলকে মাথায় নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন। এর মাঝে “দ্য স্ক্রু প্রেস” কৌশল ছিল তার আবিষ্কারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও তিনি নতুন ধারণা নিয়েও কাজ করতে থাকেন, তখনই তার মাথায় আসে ছাঁচ দিয়ে অক্ষর তৈরির ধারণা। ধাতুর তৈরি ছাঁচের অক্ষরগুলো তিনি এমনভাবে তৈরি করেন যেন সেগুলো পুনরায় ব্যবহার করা যায়। এরপর সেই ছাঁচের অক্ষরগুলোকে তিনি একটি কাঠের ফ্রেমে আবদ্ধ করেন, যেন একটি পৃষ্ঠায় অক্ষর ও বাক্যগুলো সোজা লাইনে ও সুবিন্যস্ত আকারে থাকতে পারে। এটাই ছিল আধুনিক ছাপাখানা শিল্পের প্রথম পদক্ষেপ। এর ফলে হাতে লেখার চেয়ে অনেক দ্রুত ও কম সময়ে বই লেখা অর্থাৎ প্রকাশ করা সম্ভব হয়। যদিও সেটির মাঝেও বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। যেমন- কাগজগুলোতে কেবল লেখা ব্যতীত অন্যান্য কাজ, যেমন- বিভিন্ন রং করা কিংবা ডিজাইন করা- ইত্যাদি তখনো হাতেই করতে হত।

 

5.আধুনিক ছাপাখানার ইতিহাস

গুটেনবার্গের সৃষ্টি

দুঃখজনকভাবে গুটেনবার্গ ছাপাখানার লেখা কোনগুলো সেগুলো নির্ণয় করা বর্তমান সময়ে এসে অসম্ভবপর হয়ে গিয়েছে। কেননা, সে সময়ে বর্তমান যুগের মত কপিরাইট আইন ছিল না এবং গুটেনবার্গের নব্য ছাপাখানা ও অক্ষরের আদলে সমগ্র জার্মানি তথা ইউরোপে একই ধাঁচ ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও গুটেনবার্গ তার ছাপাখানায় কখনো তারিখ বা নিজের নাম বা প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করেন নি। তবে আধুনিক গবেষকদের মতে, গুটেনবার্গ প্রেসে ছাপানো প্রথম বইটি ছিল সম্ভবত জার্মান কোনো কাব্যগ্রন্থ। এরপর ছাপানো হয় জার্মান ব্যাকরণ বিষয়ক একটি বই যা ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হত। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যায় তার একটি কাজ। সেটি তিনি করেন ১৪৫২ সালে, যা বর্তমান “গুটেনবার্গ বাইবেল” নামে পরিচিত।

 

6.আধুনিক ছাপাখানার ইতিহাস

গুটেনবার্গ বাইবেল

ছাপাখানা শিল্পের ইতিহাসে “গুটেনবার্গ বাইবেল”কে ধরা হয় সবচেয়ে বৈপ্লবিক সৃষ্টি। ১৪৫২ সালে জোহানেস গুটেনবার্গ নিজ উদ্যোগে বাইবেল ছাপানোর কাজ হাতে নেন। একারণে তিনি ছাপাখানার যন্ত্রন্নোয়নে নিয়মিত কাজ করতে থাকেন। ৩ বছরের ব্যবধানে, অর্থাৎ ১৪৫৫ সালে মোট ২০০ কপি বাইবেল ছাপিয়ে ফেলেন। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এ সংখ্যা নিতান্তই হাস্যকর হলেও সে সময়ের জন্য এটি ছিল অত্যন্ত দ্রুত। আর তখনকার সময়ে সে বাইবেলের কদর করার মত লোক কম ছিল বিধায় প্রচুর অর্থসংকটেও পড়তে হয় তাকে। ফলে ইতিহাস বিখ্যাত“গুটেবার্গ বাইবেল”ছাপালেও তিনি ঋণী হয়ে পড়েন। এতে ছাপাখানার মূল অর্থ যোগানদাতা ফিউস্ট গুটেনবার্গকে তার কাজ থেকে অব্যাহতি দেন এবং পরবর্তীতে গুটেনবার্গ আর কখনো এই কাজে ফেরত যেতে পারেন নি। যদিও অনেক গবেষকের মতে, গুটেনবার্গকে তার প্রেসে আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।

 

7.আধুনিক ছাপাখানার ইতিহাস

তবে সত্য যাই হোক না কেন, গুটেনবার্গ তার জীবৎকালে এই অসাধারণ আবিষ্কারের পরেও সেটি থেকে কখনো তেমন অর্থ উপার্জন করতে পারেন নি। জোহানেস গুটেবনার্গকে জার্মানির মাইনয এর আর্চবিশপ ফন নাসাউ ১৪৬৮ সালে গুটেনবার্গের মৃত্যু পর্যন্ত তার বাইবেল ছাপানোর উদ্যোগের প্রশংসাস্বরূপ নিয়মিত পেনশন প্রাদান করতেন, যা শুধুমাত্র তার স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্যই যথেষ্ট ছিল। গুটেনবার্গ বাইবেলের ২০০ কপির মাঝে বর্তমানে ২১টি বাইবেল রয়ে গিয়েছে যার সবগুলো বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। গুটেনবার্গ এই বাইবেলগুলোয় ল্যাটিন অক্ষরের ব্যবহার করেন। এই “গুটেনটেনবার্গ বাইবেলের” প্রতিটি পৃষ্ঠায় ৪২টি করে লাইন ছিল। বাইবেলগুলোর মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২৮৬টি করে। এক একটি পৃষ্ঠায় মোট অক্ষর ও চিহ্ন ছিল ২ হাজার ৫০০টি করে। প্রতিটি বাইবেলের ভর ছিল ১৪ পাউন্ড। গুটেনবার্গের বাইবেল ও এই বহনযোগ্য ছাপাযন্ত্র বই ছাপানো তথা বর্তমান সমাজে অগ্রগতিতে বিরাট ভূমিকা রাখে। এক পরিসংখ্যানের মাধ্যমে বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে বলা যায়, ১৫শ শতকে সমগ্র ইউরোপে মোট ছাপানো বইয়ের সংখ্যা ছিল ২০ কোটি, ৩ শতকের ব্যবধানে ১৮শ শতকে এই সংখ্যা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। আর এরই মাধ্যমে গুটেনবার্গের যুগান্তকারী আবিষ্কার সভ্যতাকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিতে সাহায্য করছে।

Place your advertisement here
Place your advertisement here