• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook
সর্বশেষ:
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অন্যতম নকশাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস, আজ ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। বন্যায় দুবাই এবং ওমানে বাংলাদেশীসহ ২১ জনের মৃত্যু। আন্তর্জাতিক বাজারে আবারও বাড়ল জ্বালানি তেল ও স্বর্ণের দাম। ইসরায়েলের হামলার পর প্রধান দুটি বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল শুরু। ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরানে।

আজ পার্বতীপুর হানাদার মুক্ত দিবস

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯  

Find us in facebook

Find us in facebook

আজ ১৫ই ডিসেম্বর। আজ থেকে ৪৮ বছর আগে ১৯৭১ সালে এই দিনে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে হানাদার মুক্ত হয়। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অগ্নিঝরা ভাষণে যখন সারা দেশের আনাচে-কানাচে স্বাধীনতা মুখী মানুষরা আন্দোলন শুরু করে, ঠিক তখনই পার্বতীপুরে শুরু হয় আইন অমান্য ও অসহযোগ আন্দোলন। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত সবকিছুর কার্যক্রম অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় ব্রিটিশ আমলে নির্মিত সবচেয়ে প্রাচীন যোগাযোগ মাধ্যম রেলপথ।

পার্বতীপুর শহরে বসবাসরত অবাঙালিদের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ শহর ঘেরাও করে সিদ্দিক মহল্লায় অগ্নিসংযোগ করে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ। এ সময় বাঙালিদের ওপর ব্যাপক গুলিবর্ষণ করে অবাঙালিরা। এতে প্রাণ হারায় আটরাই গ্রামের দুখু, কালাই ঘাটির রইচ উদ্দিন, বেলাই চন্ডির মোজাম্মেল হক ও শফিসহ প্রমুখ।

২৪ ও ২৫ মার্চ পার্বতীপুর থানার এএসআই গোলামের পরিবারের সব সদস্য, স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারী ইমাম মোল্লাসহ ১১ জন, এম আহাম্মেদের ৪ কর্মচারী, কাশিয়া তৈরির পরিবারের ৪ সদস্য, ক্যাপ্টেন ডাক্তারের পুত্র শামসাদকে হাবড়া ইউনিয়নের ভবানীপুর থেকে আব্দুল হাকিমকে কয়লার বয়লারে জীবন্ত নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে হত্যা করে। এই গণহত্যার পর পার্বতীপুরে বসবাসরত বাঙালিরা ক্রোধে ফেটে পড়ে।

২৬ মার্চ দেশব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত ট্রেনিং না থাকায় ছাত্র, শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী, যুবকরা সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে। এরপর তৎকালীন আড়াইশ বেঙ্গল রেজিমেন্ট পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা খোলাহাটীর আটরাই গ্রামে তাবু ফেলে। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আনোয়ার। এ সময় ড. আব্দুল বারী ও আব্দুল মতিনের ঘর ও তৎসংলগ্ন এলাকা তারা ব্যবহার করে। স্থানীয় যুবকদের নিয়ে সংগ্রামী দল গঠনের কাজ শুরু হয়। তাদের হাতে একজন অবাঙালি এসপি ও দুই ট্রাক চালক আটক হয়। পরে তাদের হত্যা করা হয়।

একজন পাঞ্জাবী মেজরের অধীনে ২৮ মার্চ কয়েকজন বাঙালি সৈন্য হুগলী পাড়ায় সিও অফিস চত্বরে পাহারা দিচ্ছিল। দ্বিতল ভবনে কামান পেতে মেজর বাঙালিদের তৎপরতা লক্ষ করে। ওয়ারলেসে খবর দেয়ার চেষ্টা করলে বাঙালি সৈন্যের সঙ্গে তর্ক বিতর্ক হওয়ায় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা জানতে পেরে হুগলী পাড়ার ছাত্র আব্দুল লতিফকে নির্মমভাবে হত্যার পর জ্বলন্ত বয়লারে পুড়িয়ে ফেলে। ২৯ মার্চ শহরের পুরাতন বাজারের উপেন চন্দ্রশীল ও সুভাষ চন্দ্র শীলসহ ১৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশগুলো বাড়ির একটি কুয়ার (ইন্দিরা) মধ্যে ফেলে দেয়।

১ এপ্রিল সংগ্রামী যুবক দল বৃত্তি পাড়ার নিকট মর্টার বসিয়ে সন্ধ্যায় একযোগে চতুর্মুখী আক্রমণ চালায়। শেষ রাতে হঠাৎ কামান গর্জে উঠে ও তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়। পার্বতীপুর শহরের সোয়েব বিল্ডিংয়ের উপর প্রথম শেল নিক্ষিপ্ত হয়। ২ এপ্রিল পাকসেনা ও অবাঙালিরা হিংস্রতায় উন্মুক্ত হয়ে পার্বতীপুরের ৫ বর্গ কিলোমিটার জনপদে অগ্নিসংযোগ, লুট, হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন চালায়। তারা রামপুরা গ্রামের একান উদ্দিন, ভেদলু, ব্রক্ষোত্তরের হবিবর রহমান, তাজনগর ডাঙ্গা পাড়ার আব্দুল আজিজ, হুগলী পাড়ার তালাচাবি তৈরির মিস্ত্রি আব্দুর রহমান ও সোবহানকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং নারীদের ওপর নির্যাতন চালায়। ৮ এপ্রিল সবচেয়ে বৃহৎ গণহত্যার ঘটনা ঘটায় পাকসেনারা। রংপুর থেকে পাকসেনারা ট্রেনে করে এসে বদর গঞ্জে পশ্চিমে ব্রিজের কাছে নামে।

এদিকে, পার্বতীপুর শহরের অবাঙালিদের নেতা বাচ্চা খানের নেতৃত্বে একটি সামরিক গাড়িও খোলাহাটিতে যায়। বিকেল ৩টার দিকে পাকসেনারা আক্রমণ চালিয়ে শিশুসহ প্রায় ৩শ নিরীহ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। সংগ্রামী যুবকরা ভারতের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ ট্রেনিংয়ে অংশ নেয়। ট্রেনিং শেষে পার্বতীপুরে কৃতি সন্তান মো. জালাল উদ্দিন ‘ই’ কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে ৪০ জনের মুক্তিযোদ্ধা দল নিয়ে প্রথম বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।

জুলাইয়ের প্রথম দিকে ফুলবাড়ী ভেরম নামক স্থানে ‘বেস’ ক্যাম্প স্থাপন করেন। ভেরমের ৫ কিলোমিটার পূর্বে পাকসেনাদের ‘চিন্তামন ক্যাম্প’ ও ৩ কিলোমিটার উত্তরে পাকসেনাদের ‘জলপাইতলী ক্যাম্পে’ ঘাটি ছিল। ‘বেস ক্যাম্প’ স্থাপনের ৫ দিনের মাথায় পাক সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ১৭ জন পাকসেনা মারা যায়। ৭ দিন পরে দুই দফা যুদ্ধ বেধে যায়। এবারও ৭ পাক সেনা মারা যায় এবং চিরির বন্দরের মোজাফফর হোসেন ও খাগড়া বন্দের তাহের নামের দুই মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। খয়রাত হোসেন নামে অপর এক মুক্তিযোদ্ধাকে বন্দি করে পাকসেনারা নিয়ে যায়। এছাড়াও আমজাদ হোসেন নামে এক মুক্তিযোদ্ধা গুলিতে আহত হন।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে দুটি ক্যাম্পের পাক সেনারা একত্রিত হয়ে ৭ দিন পর ৩য় দফা সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ যুদ্ধে পাকসেনারা পরাজয় বরণ করে সেখান থেকে পালিয়ে যায় কিন্তু তাদের গুলিতে তাজনগরের আব্দুল মজিদ নামের এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

অন্যদিকে ১০ নম্বর ইউনিয়নের পূর্ব হোসেনপুর গ্রামের আজিজার রহমান চৌধুরী ও তার ভাই মতিয়ার রহমান একই সঙ্গে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। চাঁচেয়া গ্রামের সহির উদ্দিন, দলাই কোঠা গ্রামের মো. শাহাবুদ্দিনকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকসেনারা এবং পরদিন খয়েরপুকুর হাটের কাছে তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

এদিকে ‘ই’ কোম্পানি পার্বতীপুরের পাটিকাঘাটের আনন্দবাজার নামক স্থানে গেরিলা ক্যাম্প স্থাপন করে। এখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ভ্যালাগাছির রেল ব্রিজের কাছে পাহারারত পাক সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। পরে ভবানীপুরের শাহগ্রাম রেল ব্রিজটি আক্রমণ করে ১৬ জন রাজাকারকে আটক করে এবং ব্রিজটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। যার ফলে ৭ দিন ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে।

ক্রমান্বয়ে ট্রেনিং শেষে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশে এসে পাকসেনাদের উপর বিভিন্ন দিকে আক্রমণ চালাতে থাকে। ১৩ ডিসেম্বর ভবানীপুর, হাবড়া, বেলাইচন্ডি, খোলাহাটি ও হরিরামপুর এলাকার পাকসেনা ক্যাম্প, রাজাকার ক্যাম্পগুলো মুক্তিযোদ্ধারা দখলে নেয়া শুরু করে। অবস্থা বেগতিক দেখে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা পার্বতীপুর থেকে পালাতে থাকে। ১৪ ডিসেম্বর ভোর ৪টার দিকে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর যৌথ হামলায় পাকসেনা, রাজাকার ও অবাঙালিরা বিশেষ ট্রেন যোগে পার্বতীপুর করে সৈয়দপুরের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। ট্রেনে স্থান না পেয়ে অনেকেই রেললাইন ধরে দল বেঁধে রওয়ানা হয়। ১৫ ডিসেম্বর রাত ১২টার পরে মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিকামী হাজার হাজার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে পার্বতীপুর শহরে প্রবেশ করতে থাকে। জয় বাংলা স্লোগান মুখরিত হয়ে উঠে চারদিক। হানাদার মুক্ত হয় পার্বতীপুর।

Place your advertisement here
Place your advertisement here