• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

Find us in facebook

মেডিটেশন কেন হারাম, যা বলে ইসলাম 

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৬ নভেম্বর ২০২১  

Find us in facebook

Find us in facebook

মানুষ কোনো না কোনো ক্ষেত্রে অশান্তিতে থাকে। কেউ শারীরিক, কেউ আত্মিক আবার কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত। এ সবকিছু থেকেই সবাই চায় মুক্তি। শান্তি ও মুক্তি পেতে ডাক্তার-কবিরাজের কাছেই যায় বেশিরভাগ মানুষ। আবার কেউ যায় সাধু-সন্ন্যাসীর কাছে। কিন্তু ইদানিং দেখা যাচ্ছে কিছু মানুষ ঝুঁকছে মেডিটেশনের দিকে। জেনে নেয়া যাক এ সম্পর্কে ইসলামের বক্তব্য কী।

মেডিটেশন (meditation) যোগ ব্যায়াম (yoga) মূলত একটি শয়তানি ফাঁদ; যা নিঃসন্দেহে হারাম। কেন হারাম; সংক্ষেপে এর কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হল–
 
১. এটি মূলত হাজার বছর পূর্বে ফেলে আসা হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান পাদ্রী ও যোগী-সন্ন্যাসীদের যোগ-সাধনার আধুনিক কলা-কৌশলের নাম। (yoga and breathing by Muhammad ‘Abd al-Fattaah Faheem p. 19)

অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
 لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّهَ بِغَيْرِنَا، لَا تَشَبَّهُوا بِاليَهُودِ وَلَا بِالنَّصَارَى

'যে অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাদৃশ্য বা মিল রেখে চলে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। তোমরা ইয়াহূদী ও নাসারাদের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখো না।' (তিরমিযী ২৬৯৫)

২. মেডিটেশনের লক্ষ্য হলো, অন্তর্গুরুকে পাওয়া। তাদের ভাষায়, ‘মেডিটেশনের মাধ্যমেই আপনি সংযোগ সাধন করতে পারেন আপনার ‘অন্তরের আমি’র সঙ্গে; আপনার শক্তির মূল উৎসের সঙ্গে।’

মেডিটেশনের এই দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের দৃষ্টিতে মারাত্মক অপরাধ। মূলত ‘অন্তরের আমি’ হল নফসে আম্মারা; যার অনুসরণের পরিণতি হল জাহান্নাম। এদেরকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ বলেন,

 أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَٰهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنتَ تَكُونُ عَلَيْهِ وَكِيلًا-أَمْ تَحْسَبُ أَنَّ أَكْثَرَهُمْ يَسْمَعُونَ أَوْ يَعْقِلُونَ ۚ إِنْ هُمْ إِلَّا كَالْأَنْعَامِ ۖ بَلْ هُمْ أَضَلُّ سَبِيلًا

'আপনি কি দেখেছেন ওই ব্যক্তিকে, যে তার প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে? তবুও কি আপনি তার যিম্মাদার হবেন? আপনি কি মনে করেন যে, তাদের অধিকাংশ শোনে অথবা বোঝে ? তারা তো চতুস্পদ জন্তুর মত; বরং আরও পথভ্রান্ত।' (সূরা ফুরক্বান ৪৩-৪৪)

৩. মেডিটেশনের একটি দাবি হচ্ছে, ‘ভ্রান্ত ধারণা ও সংস্কারের শৃঙ্খল মুক্তির পথ হচ্ছে মেডিটেশন।’ (কোয়ান্টাম টেক্সটবুক)

ইসলামের দৃষ্টিতে এটি একটি মারাত্মক ভুল দাবি। কেননা, আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (সা.) প্রদর্শিত চির কল্যাণময়, শান্তি ও মুক্তির একমাত্র পথ ইসলাম। ইসলামের মাঝেই রয়েছে মানবজাতির যাবতীয় ভ্রান্ত ধারণার উপশম এবং মানুষের তৈরি শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়ার কার্যকরি ব্যবস্থা। মহান আল্লাহ কত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন,

كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ

'এটি সেই কিতাব যা আমি তোমার প্রতি নাজিল করেছি, যেন তুমি মানুষকে বের করে আনো অনেক অন্ধকার থেকে এক আলোর দিকে।' (সূরা ইবরাহীম ০১)

৪. মেডিটেশনের দৃষ্টিভঙ্গি হল, মন সকল শক্তির উৎস চেতনা অবিনশ্বর, প্রাণ রহস্যের চাবিকাঠি।’ (কোয়ান্টাম টেক্সটবুক)

মেডিটেশনের এ বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্কারভাবে কুফর ও শিরক। কেননা, ইসলাম কেবল আল্লাহকেই সকল শক্তির মূল উৎস ও সাফল্যের চাবিকাঠি মনে করে। অন্য কোনো কিছু সব শক্তির উৎস, অবিনশ্বর, প্রাণ রহস্যের চাবিকাঠি মনে করা বা বিশ্বাস করা আল্লাহর সঙ্গে সুস্পষ্ট শিরক। আল্লাহ বলেন,

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ اللّهِ أَندَاداً يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللّهِ وَالَّذِينَ آمَنُواْ أَشَدُّ حُبًّا لِّلّهِ وَلَوْ يَرَى الَّذِينَ ظَلَمُواْ إِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ أَنَّ الْقُوَّةَ لِلّهِ جَمِيعاً وَأَنَّ اللّهَ شَدِيدُ الْعَذَابِ

'আর কোন লোক এমনও রয়েছে যারা অন্যান্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে এবং তাদের প্রতি তেমনি ভালবাসা পোষণ করে, যেমন আল্লাহর প্রতি ভালবাসা হয়ে থাকে। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতি ঈমানদার তাদের ভালবাসা ওদের তুলনায় বহুগুণ বেশি। আর কতইনা উত্তম হ’ত যদি এ জালেমরা পার্থিব কোনো কোনো আজাব প্রত্যক্ষ করেই উপলব্ধি করে নিতো যে, যাবতীয় ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহরই জন্য এবং আল্লাহর আযাবই সবচেয়ে কঠিনতর।' (সূরা বাকারা ১৬৫)

৫. কোয়ান্টাম টেক্সটবুক-এ আছে, শিথিলায়ন প্রক্রিয়ায় মানুষের মধ্যে এমন এক ক্ষমতা তৈরি হয়, যার দ্বারা সে নিজেই নিজের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে পারে! ইচ্ছা করেছেন; ঘটনা ঘটেছে। ইচ্ছা করেছেন; মানুষ রোগমুক্ত হয়েছে। আপনিও এ চাবিকাঠিকে কাজে লাগিয়ে অর্জন করতে পারেন অতিচেতনা।’

মূলত এ ধরনের বিশ্বাস ও কর্ম-তৎপরতা পরিস্কার কুফর ও শিরক। ‘কুন’ শব্দ ব্যবহারে ইচ্ছার মাধ্যমে যে কোনো ঘটানোর মালিক একমাত্র আল্লাহ। কোয়ান্টাম মেডিটেশনে এই ‘কুন’ শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে ইচ্ছা শক্তির প্রতিফলন সুস্পষ্ট শিরক। আল্লাহ বলেন,

إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ فَسُبْحَانَ الَّذِي بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ

'যখন তিনি কোন কিছু করার ইচ্ছা করেন, তখন তাকে কেবল বলতে হয় হও-ফলে তা হয়ে যায়। অতএব মহাপবিত্র ও মহাপ্রশংসিত আল্লাহ। তার হাতে আছে সকল বিষয়ের সকল ক্ষমতা। আর তার নিকটেই তোমাদেরকে ফিরে যেতে হবে।' (সূরা ইয়াসীন ৮২-৮৩)

৬. কোয়ান্টাম টেক্সটবুক-এ আছে, ‘শিথিলায়ন প্রক্রিয়ায় মানুষের মধ্যে এমন এক ক্ষমতা তৈরি হয়, যার দ্বারা সে নিজেই নিজের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে পারে। এজন্য একটা গল্প বর্ণনা করা হয়েছে যে, এক ইঞ্জিনিয়ার সপরিবারে আমেরিকায় বসবাস করার মনছবি দেখতে লাগলো। ফলে সে ডিভি ভিসা পেয়ে গেল। তারপর সেখানে ভাল একটা চাকুরির জন্য মনছবি দেখতে লাগল। ফলে সেখানে যাওয়ার দেড় মাসের মধ্যেই উন্নতমানের একটা চাকুরি পেয়ে গেল।’ অথচ ইসলাম মানুষকে তাকদীরে বিশ্বাস রেখে বৈধভাবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে বলে। আল্লাহ বলেন,

قُلْ لَنْ يُصِيْبَنَا إِلاَّ مَا كَتَبَ اللهُ لَنَا هُوَ مَوْلَانَا

'বলে দিন, আল্লাহ আমাদের ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন, তা ব্যতীত কিছুই আমাদের নিকট পৌঁছবে না। তিনিই আমাদের অভিভাবক।' (সূরা তওবা ৫১)

৭. উক্ত বইয়ের মধ্যে শিথিলায়ন প্রক্রিয়াকে আস্তিক-নাস্তিক, দরবেশ-ঋষি, মুসলিম-অমুসলিম সবার জন্য আত্মিক উন্নতির পথ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। ইসলাম সম্পর্কে যার নুন্যতম জ্ঞান রয়েছে তিনিও এই দাবীর অসারতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। ইসলামের বিধান অনুযায়ী আত্মিক উন্নতির পথ নির্ধারিত। এর সাথে বুদ্ধ, যোগী, সন্যাসী, ঋষিদের অনুসৃত শিথিলায়ন পদ্ধতির কোন সম্পর্ক নাই। আল্লাহ বলেন,
وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ

'যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিণকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্থ।' (সুরা ইমরান ৮৫ )

৮- বইটির সংশ্লিষ্ট অংশে বলা হয়েছে, ‘কথিত আছে অলৌকিক শক্তিবলে ঋষিরা ইসম বা মন্ত্র উচ্চারণ করতেন আর যাদুর মত সব ঘটনা ঘটে যেত। যে কোন ঋষিরা মন্ত্র উচ্চারণের আগে বছরের পর বছর ইসম বা মন্ত্র জপ করতেন বা জিকির করতেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আল্লাহ, ইয়াহু, ইয়া হক, ওম ইত্যাদি। ধর্মবহির্ভূত ধ্যানীরা নিজের পছন্দমত কোন শব্দ লক্ষ লক্ষবার উচ্চারণ করেন। তাদের বিশ্বাস এইভাবে অগণিতবার উচ্চারণের ফলে এই ধ্বনি এমন এক মনোদৈহিক স্পন্দন সৃষ্টিতে সহায়ক হয় যার ফলে সে তার মনোদৈহিক শক্তি পুরোপুরি একাগ্রভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়।’

এর মাধ্যমে মূলত তারা দাওয়াত দিচ্ছে, র্সবশ্বেরবাদের প্রতি; যা একাধারে কুফর ও শিরক। ইসলামে মুনী-ঋষি বা যোগী-সন্যাসীদের ন্যায় এ ধরনের ইসম বা মন্ত্রজপ বা জিকিরের কোন অস্তিত্ব নাই। যার মধ্যে ইসলামের নুন্যতম শিক্ষা রয়েছে, তিনি অবশ্যই বৌদ্ধ, যোগী-ঋষি ও হিন্দু সন্যাসীদের পথ পরিহার করবেন এবং সর্বদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথ অনুসরণ করবেন। আল্লাহ বলেন,

وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا

'যে কেউ আল্লাহ ও তার রাসূলের (সা.) আনুগত্য করে, সে অবশ্যই মহা সাফল্য অর্জন করবে।' (সুরা আহযাব ৭১)

৯. অন্যান্য বিদআতীদের ন্যায় এরাও কোরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা করেছে মুসলমানদের ধোঁকা দিয়ে দলে ভিড়ানোর জন্য। যেমন- তারা সূরা জিন-এর ২৬ ও ২৭ আয়াতের অপব্যাখ্যা করে বলেছেন, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা গায়েবের খবর জানাতে পারেন। অতএব যে যা জানতে চায় আল্লাহ তাকে সেই জ্ঞান দিয়ে দেন।’ (প্রশ্নোত্তর ১৭৫৩)।

অথচ উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তার মনোনীত রাসূল ছাড়া অদৃশ্যের জ্ঞান কারও নিকট প্রকাশ করেন না। এ সময় তিনি সামনে ও পেছনে প্রহরী নিযুক্ত করেন’। অর্থাৎ আল্লাহ তার রাসূলের নিকট ‘অহি’ প্রেরণ করেন এবং তাকে শয়তান থেকে নিরাপদ রাখেন। এই ‘অহি’-টাই হ’ল গায়েবের খবর, যা কোরআন-হাদীস আকারে আমাদের কাছে মওজুদ রয়েছে।

১০- সাধারণত মানুষ মেডিটেশন করে অন্তরের প্রশান্তির জন্য। অথচ আল্লাহ বলেন, মেডিটেশনে নয়; বরং أَلا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوب 'জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়।' ( সূরা রাদ ২৮)

মেডিটেশন তথা ধ্যান সম্পর্কে তাদের প্রশ্ন করলে তারা মুরাকাবা তথা আল্লাহচিন্তা বা আল্লাহর সৃষ্টিজগতের রহস্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সাথে তুলনা দেন। তারা বলেন, মেডিটেশন ও মুরাকাবা একই জিনিস। অথচ এটি একটি শয়তানি ফাঁদ বা প্রতারণা বৈ কিছু নয়। মুরাকাবার সঙ্গে তাদের মেডিটেশনের কোনো সম্পর্কই নেই। মেডিটেশন কোনো আসমানি কিতাব সমর্থিত পদ্ধতি নয়; এটা মানুষের মনগড়া পদ্ধতি। কোনো মানুষের আবিষ্কৃত মনগড়া পদ্ধতির সঙ্গে ইসলামের জিকির-আজকার, মুরাকাবা, সালাত, সিয়াম, জাকাত, সদকার কোনো সম্পর্ক নেই।

আমাদের সমাজে সব বয়সের নারী-পুরুষ বিশেষ করে যুবক-যুবতিদের এ পদ্ধতির প্রতি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। তারা হতাশামুক্ত, মানসিক প্রশান্তিসহ প্রায় সকল রোগের চিকিৎসার জন্য সেখানে ভিড় জমায়। অথচ হতাশামুক্ত ও মানসিক প্রশান্তি আসে মহান আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে। আল্লাহ বলেন, ‘জেনে রাখো! আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়।’ (সুরা রাদ :২৮)।

অপরদিকে সুস্থতার ক্ষেত্রে ইসলামি চিকিৎসার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে আল্লাহ বলেন, ‘আমি কুরআনে এমন বিষয় নাজিল করেছি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত। গুনাহগারদের তো এতে শুধু ক্ষতিই বৃদ্ধি পায়। (সুরা বনি ইসরাইল :৮২)

Place your advertisement here
Place your advertisement here