• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

Find us in facebook

১৭ মার্চের উদিত সূর্যকে অভিবাদন

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১৭ মার্চ ২০২২  

Find us in facebook

Find us in facebook

দেলওয়ার হাসান

আজিকে উষার শুভ্র গগনে
উদিছে নবীন সূর্য গগনে।

মহাকালের মহাদিগন্তে সেদিনও পূর্বাকাশে সূর্য উঠেছিল। দিনটি ছিল ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। পূর্ব গগনের সে নবীন সূর্যটির আলোক রশ্মি ছিলো অত্যন্ত দ্যুতিময় ও অত্যুজ্জ্বল। ছিল প্রগাঢ় রক্তিমায় আরও বেশি রক্তলাল। বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান পূর্ব বাংলার টুঙ্গিপাড়ায়। সময়টা ছিল ইতিহাসেরও মাহেন্দ্রক্ষণ। দেশে তখন ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন চলছে। যে শিশু বাগাই ও মধুমতী স্নাত শ্যামলিমা প্রকৃতির ক্রোড়ে চোখ খুলে দেখেছিল এক পরাধীন ভূমি। সে দিনই হয়তো সেই ‘খোকা’ নামের ছেলেটি তার মানসলোকে দেখেছিল স্বাধীন স্বদেশের এক স্বপ্নভূমি। সে শিশুই পরবর্তীতে ইতিহাস গড়েছে ইতিহাসের পরতে পরতে। কালক্রমে তিনি হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের রাখাল রাজা, এক স্বাধীন স্বদেশ ভূমির স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃৎ। তিনিই হলেন স্বাধীন দেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

জনগণ মন নন্দিত এই মহান নেতার জন্ম তিথিতে তাঁকে প্রাণঢালা অভিবাদন।

‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’। শৈশব, স্কুল, কলেজ জীবনেই তাঁর নেতৃত্বের প্রকাশ ছিল স্পষ্ট। বাগাই নদী ও মধুমতী তীরের দুঃসাহসী খোকার সেই দুরন্ত কৈশোরেই দর্শন মিলেছে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দীর সাথে। এ সময় থেকেই তিনি আত্মস্থ করতে থাকেন নেতৃত্বের গুণাবলী। সময়ান্তরে কিশোর নেতৃত্ব থেকে জাতীয় নেতৃত্বে এভাবেই তাঁর উত্তরণ ঘটে। প্রথমে ফরিদপুরে ও পরে কলিকাতায় অধ্যয়নকালে সোহরাওয়ার্দীর সাথে তাঁর পরিচয় হয়। নেতার সাথে অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক ক্রমাগত তাঁকে পরিণত করেছে ভাবশিষ্যে। তবে এ ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের সারথী আরও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রিয় মানিক ভাইকেও কোলকাতায় পেয়েছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একান্ত অনুসারী হিসেবে। পরে আজীবন তাঁরা সোহরাওয়ার্দীর ছত্রছায়ায় দীক্ষা নিয়েছিলেন সংসদীয় গণতন্ত্রের, অসাম্প্রদায়িক চেতনার ও মানবিক মূল্যবোধের। বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষায়: ‘আমি কাজ করিয়াছি মাঠে ময়দানে আর মানিক ভাই তাঁহার ক্ষুরধার লেখনীর দ্বারা’। বঙ্গবন্ধু ও মানিক মিয়ার নিজ নিজ ক্ষেত্রে হাতে খড়ি কলিকাতাতেই ঘটে।

দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলার রাজনীতি রাহুগ্রস্থ হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য ক্রমশ: প্রকট হতে শুরু করে। গঠন করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের। এমতাবস্থায় সোহরাওয়ার্দীর আশীর্বাদপুষ্ট প্রগতিশীল রাজনীতিবিদরা প্রথমে গঠন করেন ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে একটি বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন। পরে এটি ‘আওয়ামী লীগ’ নাম ধারণ করে। মওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও শামসুল হককে সেক্রেটারি করে এ দলের যাত্রা শুরু হলেও এর নেপথ্যে ছিলেন তখনকার তরুণ নেতা শেখ মুজিব। পরবর্তীতে তিনি শামসুল হকের স্থলাভিষিক্ত হন। ইতিহাসের প্রতি আনুগত্য রেখে এদেশের প্রতিটি ঘটনা পরম্পরার পাতা উল্টালে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হল কতকগুলো সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের  মুক্তি সংগ্রাম অগ্রসর হয়েছে। মোটা দাগে ভাষা আন্দোলন দিয়ে তা শুরু ও মুক্তি সংগ্রামে তার পরিণতি।

১৯৪৮ পর্বের ভাষা আন্দোলনকালে শেখ মুজিব গ্রেফতার হন এবং মুক্তি পান ১৯৫২ সালে। এ সময়ে মুসলিম লীগ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। ছাত্র রাজনীতিতে এর প্রভাব রয়েছে। এ সময় শেখ মুজিবের আগ্রহে গঠিত হয় ছাত্রলীগ।

সেই তরুণ বয়সেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের বঞ্চনা ও বৈষম্য নীতির বিরোধিতা করে তিনি পূর্ব বাংলার জনমত সংগঠনে মনোযোগী হন। সোহরাওয়ার্দীর পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনীতিতে তিনি সোচ্চার হলেও তাঁকে নৈতিক ও তাত্ত্বিক সহযোগিতা যোগাতেন সোহরাওয়ার্দীর আরেক ভাবশিষ্য ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া। শেখ মুজিব ও তাঁর রাজনৈতিক ও কলম সারথী মানিক মিয়ার জন্য পাকিস্তানি ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধিকার আদায় ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। লীগের অক্টোপাস থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উত্তরণ ঘটানো ছিল এই চ্যালেঞ্জের অন্যতম অভীষ্ট।

১৯৫৩ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকালে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল সংগঠকের। এ সময়ে দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশিত হলে পত্রিকাটি যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন যোগাতে থাকে। মানিক মিয়ার ‘মুসাফির’ ছদ্মনামের ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ নির্বাচনে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে। ফলে নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। কিন্তু পাকিস্তানি শাঠ্য-ষড়যন্ত্রের ফলে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেওয়া হয়। ১৯৫৬ সালের নতুন শাসনতন্ত্রে পূর্ব বাংলার স্হলে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করা হলে শেখ মুজিব প্রতিবাদী হন। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারী করা হলে শেখ মুজিব ও মানিক মিয়াসহ আরও অনেক রাজনীতিবিদ গ্রেফতার হন। ১৯৫৯ সালে ‘এবডো’ আইন জারী হলে দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়।

১৯৬২ সালে শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন কালে ও সোহরাওয়ার্দী অন্তরীণ হলে শেখ মুজিব প্রতিবাদ করেন। এ সময় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে বাধা ও বেতারে রবীন্দ্র সংগীত প্রচার বন্ধ করার অপপ্রয়াস করা হলে দেশের বুদ্ধিজীবী ও বঙ্গবন্ধুসহ প্রগতিশীল সংবাদপত্রগুলো এর প্রতিবাদ করে। ১৯৫৪ ও ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে পত্রিকা ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো সোচ্চার হয়ে ওঠে। ‘ইত্তেফাক’ শিরোনাম করে ‘পূর্ব বংগ রুখিয়া দাঁড়াও’। এটি পরবর্তীতে লিফলেট আকারে হাজার হাজার কপি ছাপা হলে ‘প্রেসের নাম নাই’ এ অজুহাতে আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিব ও মানিক মিয়ার বিরুদ্ধে ‘প্রচারপত্র মামলা’ করা হয়।

১৯৬৬ সালে লাহোরে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা প্রণয়ন করেন এবং ইত্তেফাকসহ প্রগতিশীল রাজনীতিবিদরা ৬ দফাকে সমর্থন করেন। ৭ জুন ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবীর মিছিলে গুলি করা হলে গুলিতে ১০ জন নিহত হন। এ খবর ছাপার জন্য ইত্তেফাক সম্পাদককে গ্রেফতার ও প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৯৬৭ সালে কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হলে সারাদেশ বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে এবং ছাত্ররা রাজবন্দীদের মুক্তি দাবীসহ ১১ দফা পেশ করে। ১৯৬৯ সালে এ আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে ১০ ফেব্রুয়ারি ইত্তেফাক মুক্তি পায় এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয়। বঙ্গবন্ধু নি:শর্ত মুক্তি পান। ইত্তেফাক ‘জয় নিপীড়িত জনগণ, জয় জয় নব উত্থান’ শিরোনামে কালজয়ী সম্পাদকীয় ছাপে। বঙ্গবন্ধু মুক্তিলাভের পর ছাত্র-জনতার পক্ষ হতে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিব প্রণীত ৬ দফা ভিত্তিক কর্মসূচির বিপরীতে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম হয় ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে’। আরেক শিরোনামে বলা হয় ‘চির অবনত তুলিয়াছে আজ শির’।

কিন্তু নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্বেও পাকিস্তানি শাসকেরা ১৯৭১ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। উপরোন্ত তারা গণহত্যার আশ্রয় নেয়। বঙ্গবন্ধু এ সময় স্বাধীনতার ডাক দেন। বাঙালিরা সে ডাকে সারা দিয়ে ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীন ভূমিতে ফিরে আসেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। তিনি রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলাকে জাতীয় সংগীত নির্বাচন করে গোটা বাঙালি জাতিকে চির কৃতজ্ঞ করেছেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ও কতকগুলো মূল নীতির উপর দেশ গড়ার ডাক দেন। কিন্তু শত্রু ওত পেতে ছিল। ঘরে-বাইরের এ ষড়যন্ত্রের কারণে মুক্তির সোপান তলে এসেও এ মহান নেতাকে জীবন দিতে হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট।

বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় একজন রাষ্ট্রনায়কের সকল গুণাবলী অর্জন করেছিলেন বলেই তিনি আজ জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধুর মানবিক প্রতিভার স্বীকৃতি হল তার জুলিও কুড়ি পদক লাভ। তিনি পরিচিত হলেন ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ নামে। তাই ১৭ মার্চের উদিত সূর্য কখনো অস্তমিত হওয়ার নয়। অন্নদা শংকর রায়ের ভাষায়:

যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরি মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

Place your advertisement here
Place your advertisement here