• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook
সর্বশেষ:
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অন্যতম নকশাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস, আজ ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। বন্যায় দুবাই এবং ওমানে বাংলাদেশীসহ ২১ জনের মৃত্যু। আন্তর্জাতিক বাজারে আবারও বাড়ল জ্বালানি তেল ও স্বর্ণের দাম। ইসরায়েলের হামলার পর প্রধান দুটি বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল শুরু। ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরানে।

ঘৃণ্য আইন ইনডেমনিটি

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৯ জুলাই ২০২১  

Find us in facebook

Find us in facebook

ব্যারিস্টার মিতি সানজানা   

পৃথিবীর সব রাষ্ট্রেরই লক্ষ্য সর্বোত্তমভাবে প্রত্যেক জনগণের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। কোনো নাগরিকের আইনগত অধিকার লঙ্ঘিত হলে তিনি দেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী প্রতিকার লাভের অধিকারী এবং এই অধিকার লঙ্ঘনের উপযুক্ত প্রতিকার পাওয়া তাঁর সাংবিধানিক অধিকার।

বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে, সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ অনুযায়ী সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং প্রত্যেক নাগরিক আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান ও আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। বিচারব্যবস্থায় সব নাগরিকের সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র  Universal Declaration of Human Rights (UDHR)-এর ঘোষণা প্রদান করা হয়। প্রত্যেক মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে এই সনদ ঘোষিত হয়। এই ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবে বলা আছে যে সব মানুষ আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং কোনো বৈষম্য ব্যতিরেকে প্রত্যেকেই আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। বিচার প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক মানুষ সমান এবং প্রত্যেকেই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালতে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারী।

কিন্তু ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের ইতিহাসে বিচারহীনতার এক করুণ ইতিহাস রচিত হয়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল এই দিনে। বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারের ১৮ জনকে হত্যা করা হয় সেই রাতে।

সেই সঙ্গে আরো লজ্জাজনক বিষয় হলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের জঘন্যতম ও নৃশংস এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর সংসদে পাস করার সুযোগ না থাকায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের এবং হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সব ব্যক্তির দায়মুক্তি দিতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন আইন প্রণয়নের কোনো নজির কোথাও নেই, যার দ্বারা এমন নৃশংস হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে মানবাধিকারের এমন চরম লঙ্ঘন কখনো কোথাও ঘটেনি। ওই সময় সেনাপ্রধান ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাত্র ৯ দিনের মাথায় ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন জিয়াউর রহমান। আর খন্দকার মোশতাক সরকার ছিল স্বঘোষিত এবং সম্পূর্ণভাবে সেনাসমর্থিত একটি সরকার।

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক এই আইনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিচারকাজ আদালতবহির্ভূত রাখার জন্য এই অধ্যাদেশ বা আইন জারি করা হয়। কোনো বিচারকাজ আদালতবহির্ভূত রাখার জন্য আইনসভা যে আইন পাস করে তাকেই ইনডেমনিটি আইন বলে। এটি ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নম্বর ৫০ নামে অভিহিত ছিল। পরবর্তী সময়ে ‘পঞ্চম সংশোধনী আইন ১৯৭৯’ সালে সংসদ কর্তৃক অনুমোদন করা হয়। যার ফলে এটি আনুষ্ঠানিক আইন হিসেবে অনুমোদন পায় এবং এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এই বিচারহীনতা আর কলঙ্কের এক নতুন অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে এই আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ ও ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিল সংবিধান (সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯। এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৮ অনুচ্ছেদে সংযুক্ত করা হয়েছিল।

পঞ্চম সংশোধনীকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে বৈধতা না দিলে সেই সময়ই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা যেত।১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ১৯৭৬ সালের ১২ নভেম্বর প্রথম ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বিল সর্বসম্মতিক্রমে সংসদে পাস হয়। আজকের এই দিন বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি কালো দিন, কারণ এই দিনেই মূলত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সুরক্ষা প্রদান করা হয়।

ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা একটি পবিত্র ও মহান দায়িত্ব। বিচারে বিলম্ব আর বিচার না পাওয়া একই কথা। আর আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বিচার বন্ধ করে হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দেওয়া, এমন অপরাধ তো মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা।

লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং সহযোগী পরিচালক, আইসিএলডিসি।

Place your advertisement here
Place your advertisement here