• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৫ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook
সর্বশেষ:
মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ইতিহাসে অনন্য: রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিরা হস্ত‌ক্ষেপ করবে না: ওবায়দুল কাদের লালমনিরহাটে যুবলীগ কর্মীর পায়ের রগ কাটলেন যুবদল নেতা বাসার ছাদ থেকে পড়ে যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু ঠাকুরগাঁওয়ে ঈদ-নববর্ষে ১০ জন নিহত, আহত ২ শতাধিক

অন্ধকার সরিয়ে আলোর পথে আসার দিন

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১১ জুন ২০২১  

Find us in facebook

Find us in facebook

আবদুল মান্নান 

যদি বলি ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু পরিবার অন্তত এই মুহূর্তে অপরিহার্য’—অনেকে তা মানতে চাইবেন না, মানতে না চাইলেও এটিই বাস্তবতা । ১৯৪৯ সালে জন্ম থেকে শুরু করে দীর্ঘ ৭২ বছর আওয়ামী লীগের ইতিহাস রূপকথাকেও হার মানায়। দলটি নিষিদ্ধ হয়েছে একাধিকবার, ভেঙেছে কয়েকবার, আবার সেই রূপকথার পাখির মতো উঠে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার প্রাণপুরুষ জাতির পিতার দুই জীবিত কন্যার একজন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এবার নিয়ে তাঁর সরকার দেশ শাসন করছে চারবার আর নিরবচ্ছিন্নভাবে সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন টানা তৃতীয়বার। আওয়ামী লীগের ৭২ বছরের ইতিহাসে যখন দলটি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান অথবা পাকিস্তানের কেন্দ্রে সরকার গঠন করেছে (একক বা জোটবদ্ধ হয়ে) সব সময় জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সব সময় দলটি যে তার সম্পূর্ণ মেয়াদ শেষ করেছে তা নয়। সেই ইতিহাসের সমাপ্তি টেনেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। এরপর মাঝখানে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়ার শাসনকাল। খালেদা জিয়া নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাঁর ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করেছিলেন। ২০০৬ সালের ২৯ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। পরদিন তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত সেনাসমর্থিত নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান। তখন কেউ ধারণা করেনি যে দেশটাতে বিরাজনৈতিকীকরণের একটি নতুন ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে মাত্র এবং এই ষড়যন্ত্রেও প্রধান টার্গেট বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সরল বিশ্বাসে শেখ হাসিনা শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে নিজে উপস্থিতও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু পরিবারের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পরিবারের সদস্যরা সব কিছু সরল মনে বিশ্বাস করেন এবং এর ফলে তাঁরা শুধু নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তা নয়, জাতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিবারের সেই ঐতিহ্য এখনো চলমান। 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিকভাবে একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে ৯০ দিনের মধ্যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরে যাওয়া। কিন্তু কয়েক দিন না যেতেই দেখা গেল এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আসল উদ্দেশ্য কী। বিষয়টা ব্যাখ্যা করার জন্য পাঠকদের ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই। ঢাকার গুলশানে একটি অভিজাত কমিউনিটি সেন্টারে ২০০৬ সালের নির্বাচন সামনে রেখে দেশের বেশ কিছু স্বনামধন্য সুধীজনের একটি মেলা বসেছিল। মেলার নাম ছিল ‘যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন’। আয়োজকদের অন্যতম ছিলেন দেশের দুটি বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকার দুজন সম্পাদক। সেই মেলায় দেশের প্রায় সব নামকরা সুধীজন উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের দাবি আসন্ন নির্বাচনে সব দলকেই প্রার্থী দেওয়ার সময় তাঁদের শিক্ষা, সততা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। একটি রাজনৈতিক দল কোন নির্বাচনে কাকে মনোনয়ন দেবে, সেটি সেই দলের ব্যাপার। এখানে অন্যদের সরাসরি হস্ত্তক্ষেপ কাম্য নয়। সভা শেষে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, কোনো একটি আসনে তাঁদের ভাষায় ‘যোগ্য’ প্রার্থী যদি দেওয়া না হয় তখন তারা কী করবেন? উত্তরে তিনি সরাসরি বলেছিলেন, তখন তাঁরা নিজেরাই সেখানে একজন যোগ্য প্রার্থী দেবেন। এ প্রসঙ্গে আরেকজনের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে উত্তরে তিনি বলেন, কোনো আসনে প্রার্থী দেওয়া তাঁদের কাজ নয়। তাঁদের কাজ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর কিছুটা চাপ সৃষ্টি করা, যাতে তারা যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থী দেয়। যিনি বলেছিলেন, তাঁরা প্রয়োজনে নিজেরা প্রার্থী দেবেন, তিনি কিছুদিনের মধ্যেই একটি রাজনৈতিক দল দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন; যদিও তিনি জানেন তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি হতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে তিনি কোনো ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিজয় লাভ করতে পারবেন না। যখন তিনি নিজ দল গঠন করেন, তখন দেশে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ছিল। ড. ফখরুদ্দীন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।

সরকার গঠন করেই ড. ফখরুদ্দীন সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ নেতা-নেত্রীদের গ্রেপ্তার শুরু করে। তাঁর সরকারকে সহায়তা করেন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ। আর সেনাপ্রধানের দক্ষিণ হস্ত হিসেবে আবির্ভূত হন একজন বর্ষীয়ান সাংবাদিক, যিনি নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর কৃপাধন্য। শুধু রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের আটক করেই ফখরুদ্দীন সরকার ক্ষান্ত হয়নি, জেলে যেতে হয় অনেক ব্যবসায়ীকে। অন্যদিকে সেই বর্ষীয়ান সাংবাদিকের সহায়তায় বড় বড় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে জোরপূর্বক কোটি কোটি টাকা আদায় করার ব্যবস্থা করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কিছু সদস্য। সহায়তার হাত বাড়ান জেনারেল মইন উ আহমেদ। আওয়ামী লীগ প্রধান দেখছেন যে সরকারের কাজ একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা, তারা তা না করে আর সব কিছুই করছে। সেই দুই সম্পাদকের সংবাদপত্র একটি নতুন স্লোগান চালু করল। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলকে সংস্কার করে দেশের রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে আর তা করতে হলে প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপ্রধানকে সরে যেতে হবে। বাস্তবতাটা হচ্ছে, শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে হবে। খালেদা জিয়া এখানে শিখণ্ডী। পরবর্তীকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা, যিনি একসময় বঙ্গবন্ধুর কৃপাধন্য ছিলেন, তিনি স্বীকার করেছেন বিএনপির কথা বলতে হয় ব্যালান্স করার জন্য। ২০০৭ সালের মার্চ মাসে শারীরিক চিকিৎসা ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে শেখ হাসিনা লন্ডনে যান। তখনই জেঁকে বসা ড. ফখরুদ্দীন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল শেখ হাসিনাকে আর দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না। সব বিমান সংস্থাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তারা যেন শেখ হাসিনাকে বহন না করে। শেখ হাসিনা তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। যেকোনো মূল্যে তিনি দেশে ফিরবেনই। একাধিকবার তিনি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে ফিরেও আসেন। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার দৃঢ়তার প্রতি নতি স্বীকার করে মে মাসের ৭ তারিখে তাঁকে দেশে ফিরে আসতে দেওয়া হয়। এসে তিনি দেখেন দেশে সামরিক আইন জারি হলে যেমনটা হয় ঠিক একই কায়দায় দেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নানা অজুহাতে ধরপাকড় শুরু হয়ে গেছে।

ধরপাকড়ের এক পর্যায়ে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই শেখ হাসিনাকে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, উৎকাচ গ্রহণসহ নানা ‘অপরাধে’ আটক করা হয়। তখন বোঝা যায় আসল ষড়যন্ত্রের রূপ। তাদের ধারণা, একজন শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে অপসারণ করতে পারলে কেল্লা ফতে। যেদিন শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয় সেদিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়। শেখ হাসিনা আগেই জানতে পেরেছিলেন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে, তার কারণ হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে যাঁরা ৯০ দিনের বাধ্যবাধকতা পার করার পরও ক্ষমতায় থাকতে বদ্ধপরিকর, তাঁদের ধারণা, শেখ হাসিনাকে যদি আটক করা যায়, তাহলে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি দুর্বল হয়ে যাবে এবং দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নির্বাসনে যাবে, তাঁদের আসন পাকাপোক্ত হবে। তাঁদের এই ধারণা ছিল নিছক কল্পনাপ্রসূত। কারণ আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুসহ দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা-নেত্রীদের অসংখ্যবার জেলে যেতে হয়েছে; কিন্তু দল কখনো দুর্বল হয়নি, বরং আরো নবরূপে তার আবির্ভাব হয়েছে। গ্রেপ্তারের সময় শেখ হাসিনাকে যেভাবে হেনস্তা করা হয়, তা যেকোনো বিবেকবান মানুষকে বিচলিত করেছে। অনেকের পক্ষে অশ্রু সংবরণ করা অসম্ভব ছিল। শেখ হাসিনার যত দোষই থাকুক, দিনশেষে তিনি তো জাতির পিতার কন্যা, যাঁর জন্ম না হলে এই স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি হতো না। শেখ হাসিনা তাঁর সুধা সদনের বাসভবন ত্যাগ করার আগে ১৬ জুলাইয়ের সকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টাকে একটা ফোন করেছিলেন, যিনি বঙ্গবন্ধুর কৃপায় একসময় আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই ব্যক্তি শেখ হাসিনাকে একটু সান্ত্বনা দেওয়ার পরিবর্তে তাঁর সঙ্গে খুবই রূঢ় ব্যবহার করেছিলেন। সেই ব্যক্তি এখনো বেঁচে আছেন; কিন্তু কালের অতলে হারিয়ে গেছেন আর শেখ হাসিনা বাংলাদেশের টানা তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী। একেই বলে প্রকৃতির বিচার।

শেখ হাসিনাকে আটক রাখার জন্য আগে থেকেই সংসদ এলাকায় একটি ভবন নির্ধারণ করে রাখা হয়েছিল। তাঁকে সেখানে স্থানান্তর করা হয়। পিতার মতো শেখ হাসিনার কারাগারে যাওয়াটা নতুন কিছু নয়। ১৯৮৩, ১৯৮৫, ১৯৯০ সালেও তিনি আটক হয়েছিলেন, গৃহবন্দি ছিলেন। পরিবারের মৃত্যুর পর দীর্ঘ ছয় বছর শেখ হাসিনাকে বিদেশে নির্বাসিত জীবন যাপন করতে হয়েছে। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন কয়েকবার। সর্বশেষ তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা হয়েছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, যখন তাঁর সভাস্থলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বৃষ্টির মতো আরজেস গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল। নেতৃত্বে ছিলেন খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র বর্তমানে লন্ডনে পলাতক তারেক রহমান।

শেখ হাসিনার ‘অপরাধ’ বিচার করার জন্য সংসদ ভবনের একটি কক্ষে বসানো হয় একটি আদালত, যেখানে তাঁর আইনজীবী ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। শেখ হাসিনার মামলা লড়ার জন্য বেশ কিছু সিনিয়র আইনজীবীকে অনুরোধ করা হয়েছিল, যাঁদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও ছিলেন, যাঁরা ২০০৬ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এলেন বর্ষীয়ান আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, যিনি বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ছিলেন। সঙ্গে আওয়ামী লীগদলীয় কিছু আইনজীবী। আসলে শেখ হাসিনার জন্য বসানো আদালতে বিচারের নামে প্রহসন চলছিল। সব দেখেশুনে একদিন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলতে বাধ্য হলেন, যেভাবে আদালতে বিচারের নামে প্রহসন চলছে, তাতে আইনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে মুক্ত করা কিয়ামত পর্যন্ত সম্ভব হবে না। শেখ হাসিনার বিচারের নামে যখন এসব প্রহসন চলছিল, তখন বর্ণিত সেই দুই পত্রিকার সম্পাদক লাগাতার প্রচার করেই চলেছেন, দুই নেত্রীকে কারাগারে যেতে হবে, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতি শুদ্ধ হবে। একজন তো তাঁর পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় স্বনামে এই বিষয়ে একটি সম্পাদকীয় লিখে ফেললেন। রাতের বেসরকারি টেলিভিশনের টক শোগুলো বেশ সরগরম। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, শেখ হাসিনা কারাগারে আর খালেদা জিয়া মুক্ত। বর্ণিত ব্যালান্সে রাজনীতির প্রতীক হিসেবে খালেদা জিয়াকে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৩ তারিখ দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে আটক করা হয়। তাঁকেও সংসদ এলাকায় একটি ভবনে রাখা হয়। শেখ হাসিনা এবং পরে খালেদা জিয়ার আটক ২০০৬ সালে গুলশানে যেসব সুধীজন ‘যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন’ নামে মেলা বসিয়েছিলেন, তার প্রায় সবাই সমর্থন করেন। তাঁদের কয়েকজন বিদেশে রাষ্ট্রদূতের পদ বাগিয়ে নিয়ে বিদেশে চলে যান। কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদ বাগিয়ে নেন। আবার কিছু সুধী নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নিজেরা রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং বিনা বাধায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। তাঁদের দলের নাম হয় ‘কিংস পার্টি’। সবাই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। রাজনীতিতে এমন নাদানের সমারোহ এর আগে কখনো দেখা যায়নি।

বিষয়টা আসলে কখনো দু্ই নেত্রীর ছিল না। ছিল এক নেত্রী, শেখ হাসিনা। খালেদা জিয়াকে ওই ব্যালান্স তত্ত্বে ডামি বানানো হয়েছিল। শেখ হাসিনার তুলনায় খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা নস্যি। খালেদা জিয়া ঘটনাচক্রে একটি দলের চেয়ারপারসন আর দু-দুবারের প্রধানমন্ত্রী। তিনি যখন কারাগারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁর দলকে দুই টুকরা করতে সক্ষম হয়েছিল। শত চেষ্টা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে তা করা সম্ভব হয়নি, যদিও দু-একজনের মনে এমন একটি চিন্তা-ভাবনা যে ছিল না তা কিন্তু নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, দলের প্রতি তৃণমূল নেতাকর্মীদের বিশ্বস্ততা আর শেখ হাসিনার প্রতি তাঁদের নিরঙ্কুশ সমর্থন দলকে কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারেনি, বরং দলের ঐক্য আরো সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বিএনপি যখন ঘর সামলাতে ব্যস্ত তখন শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে তত্ত্বাবধায়ক (তখন অসাংবিধানিক) সরকারের ওপর দেশের ভেতরে ও বাইরে চাপ বাড়ছিল। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি (তখন তিনি কংগ্রেস নেতা) প্রণব মুখোপাধ্যায় নিজ উদ্যোগে শেখ হাসিনার মুক্তি দাবি করেছিলেন। এই বিষয় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বেশ সোচ্চার ছিল। তারা জবরদস্তিমূলক ক্ষমতা দখল করে রাখাকে অন্যায় বলে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সরকারের তুমুল সমালোচনা করেছিল। পরিস্থিতি বাইরে যাওয়ার আগেই শেখ হাসিনাকে বিনা শর্তে ২০০৮ সালের ১১ জুন কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বীরের বেশে অমৃতের কন্যা শেখ হাসিনা কারাগার থেকে আজকের দিনে বের হয়ে এসেছিলেন। ১৯৮১ সালের মে মাসে যখন ছয় বছর প্রবাসজীবন শেষ করে দেশে ফেরেন, ১৯৯৬ সালে যখন নির্বাচনে বিজয় লাভ করে তিনি প্রথমবারের মতো দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনেন, ২০০৮ সালের এই দিনে যখন তিনি ড. ফখরুদ্দীনের কারাগার থেকে মুক্ত হন, ২০০৮ সালের ডিসেম্বর নির্বাচনে জিতে শেখ হাসিনা যখন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেন, প্রতিবারই মনে হয়েছে নির্বাসন থেকে বাংলাদেশ ঘরে ফিরেছে।

শেখ হাসিনা ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৩ বছর দেশ শাসন করছেন। এই ১৩ বছরে তিনি আর শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি বিশ্বনন্দিত একজন রাষ্ট্রনায়ক, যিনি একটি অপুষ্টিতে ভোগা বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে দিয়েছেন। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের করে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নিয়ে গেছেন। এমন একটি বাংলাদেশ তিনি নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন যে বাংলাদেশ অন্য দেশকে ঋণ দিতে পারে, খাদ্য রিলিফ দিতে পারে, মিয়ানমারের ১২ লাখ নাগরিককে তাদের ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে শরণার্থী হয়ে আসা মানুষকে আশ্রয় দিতে পারে। একজন শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে তাঁর নিজের আইডেনটিটি বা পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন আর নিজে হয়েছেন ১৭ কোটি মানুষের এই দেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার তুলনা তিনি নিজেই।

আজকের দিনে একটি কথা না বললেই নয়, শেখ হাসিনা কোনো অবস্থায়ই শঙ্কামুক্ত নন। হতে পারে তাঁর চারপাশে যাঁরা তাঁকে সর্বক্ষণ ঘিরে থাকেন তাঁর প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত নয়, ঠিক যেমন বঙ্গবন্ধুর বেলায় সত্য ছিল। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দেশের ভেতরে যেমনভাবে বেশ সক্রিয় তার চেয়ে বেশি সক্রিয় দেশের বাইরে। ষড়যন্ত্রকারীদের সদর দপ্তর লন্ডনে এটি এখন ওপেন সিক্রেট। অর্থ জোগান দেয় পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কতটুকু সতর্ক জানি না। তবে আজকের দিনে এই প্রার্থনা করতে পারি, সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে দীর্ঘায়ু হোন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। অনেক ঝড়ঝাপটা মোকাবেলা করে শেখ হাসিনাকে যে আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছেন শুধু তাঁর বা তাঁর পরিবারের জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্যও। জয়তু শেখ হাসিনা।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক।

Place your advertisement here
Place your advertisement here