• মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪ ||

  • কার্তিক ৬ ১৪৩১

  • || ১৭ রবিউস সানি ১৪৪৬

Find us in facebook

পঞ্চগড়ের ভিতরগড় দেড় হাজার বছরের প্রাচীন দুর্গনগরী

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১৬ জুন ২০২৪  

Find us in facebook

Find us in facebook

পাঁচটি গড়ের সমন্বয়ে গঠিত পঞ্চগড়ের মধ্যে ভিতরগড় একটি গড়। পঞ্চগড় জেলা সদর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল। এটি মধ্যযুগের একটি দুর্গ নগরী ছিল। সম্পূর্ণ এলাকার আয়তন ২৫ বর্গ কিলোমিটার। ইতোমধ্যে খননকাজ করে ভিতরগড় দুর্গের অভ্যন্তরে ২২ প্রত্নস্থল চিহ্নিত করা হয়েছে। 

জানা গেছে, এইসব প্রত্নস্থল থেকে কিছু প্রত্ন নিদর্শনও সংগ্রহ করা হয়েছে। চিহ্নিত করা প্রত্নস্থলগুলো আবারও মাটি দিয়ে ঢেকে রাখায় বাইরে থেকে কেউ বেড়াতে এলে তা দেখানো সম্ভব হচ্ছে না। অথচ সরকার উদ্যোগ নিলে এই দুর্গ নগরীর খনন কাজ শেষ করে এখানে সব ধরণের সুযোগ সুবিধা দিয়ে প্রত্ন পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এবং ভিতরগড়ের প্রত্ন নিদর্শন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেতে পারে।

শুধু বাংলাদেশ নয়, ভিতরগড়কে প্রত্ন পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলা গেলে এখানে পার্শ্ববর্তী ভারত, নেপাল ও ভুটান এমনকি চীন থেকেও পর্যটকরা এখানে ভিড় জমাবে। সেইসঙ্গে ওই এলাকার মানুষদের কমিউনিটি ট্যুরিজমের আওতায় আনতে পারলে তারাও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি সরকারও প্রতি বছর এখানে থেকে রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব আয় করতে পারবে।  

ভিতরগড় দুর্গনগরী পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নে অবস্থিত। দেশের যেকোনো স্থান থেকে পঞ্চগড়ে এসে জেলা শহর থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তরে পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা মহাসড়কের বোর্ড অফিসে নেমে সেখান থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার পূর্বে গেলেই এগোলেই পৌঁছে যাবে এই দুর্গনগরীতে। এই দুর্গ নগরীটি প্রায় ২৫ বর্গকিলোমিটার ব্যাপ্ত এলাকা নিয়ে বিস্তৃত। পুরো দুর্গটি কয়েকটি স্তরে চারটি আবেষ্টনী দেয়াল দিয়ে বিভক্ত ও এর উত্তর দিকের দেয়াল এবং পূর্ব-পশ্চিম দেয়ালের কিছু অংশ ভারতের জলপাইগুড়ি জেলায় পড়েছে। 

১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে বুকানন হ্যামিল্টন ভিতরগড় পরিদর্শন শেষে লিখেছিলেন, “ভিতরগড় নগরীটি চারটি আভ্যন্তরীক গড়ের সমবায়ে গঠিত। গড়গুলির একটি অপরটির অভ্যন্তরভাগে অবস্থিত। রাজার প্রাসাদ অবস্থিত ছিল সবচেয়ে ভিতরের গড়ে। সবচেয়ে ভিতরের এবং মধ্যবর্তী নগরীর উপবিভাগ ছিল। প্রতিটি নগরী সুউচ্চ দুর্গপ্রাচীর ও সুবৃহৎ পরিখা দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল যার প্রস্থ প্রয় ৫০ ফুট এবং গভীরতা ১০ থেকে ১৫ ফুট। দুর্গের প্রাচীর মাটি ও ইটের মিশ্রণে তৈরি ছিল। দুর্গ নগরীটি কয়েকটি ক্ষুদ্র নগরীতে বিভক্ত ছিল। পূর্ববাহুর সবচেয়ে বাইরের নগরীতে নিম্নবর্গীয় মানুষজন বসবাস করতো এবং স্থানটির নাম ছিরৎল হরিরঘর।”

প্রত্নতত্ত্ববিদরা ধারণা করেন, দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন পৃথু রাজা এবং এটিকে তিনি রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। একটি রাজধানীর জন্য যা যা প্রয়োজন সবই ছিল এই রাজধানীতে। আছে বিশাল মহারাজার দিঘী। কথিত আছে রাজধানীতে এক অচ্ছুত জাতের আক্রমণে টিকতে না পেরে এই দিঘীর পানিতে ডুবে সপরিবারে আত্মাহুতি দেন পৃথু রাজা। ইতিহাসবিদদের মতে, ১২৫৭ সালে সুলতান মুঘিসউদ্দীন কামরূপ রাজ্য আক্রমণ করলে এটি সুলতানী শাসনে চলে আসে। ১৪৫৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ভিতরগড় অঞ্চলটি কামরূপ রাজ্যের হোসেন শাহ শাসন করেছেন। এ ছাড়াও এ অঞ্চলটি একসময় গৌড় ও প্রাগজ্যোতিষপুরের অংশ ছিল বলে মনে করা হয়। খনন কাজের সময় দুর্গটিতে দুটি প্রাচীন মন্দিরও আবিষ্কৃত হয়।

২০০৮ সালে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) এর অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুসনে জাহানের হাত ধরে শুরু হয় ভিতরগড় প্রত্নস্থলে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের কাজ। উল্লেখ্য যে, এটাই পঞ্চগড় জেলার প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন। এরপর থেকে প্রতিবছর শীতকাল ইউল্যাবের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের নিয়ে পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের মাধ্যমে ইতোমধ্যে চারটি বেষ্টনী, এর পরিখাগুলো এবং এই চারটি বেষ্টনীর ভেতরের জায়গাটাতে যেসব স্থাপনা আছে সেগুলো সব চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। তার মধ্যে আটটি স্থাপনা খনন করে বের করা হয়েছে। বাকিগুলো খনন না করলেও চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রাচীন দূর্গনগরী ভিতরগড়ের রূপরেখা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। এটির ইতিহাস ও গবেষণার কাজ শেষের দিকে বলে জানিয়েছেন ড. জাহান।

গত দুই বছর আগে হিমালয় সুউচ্চ কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতমালা আশার আলো দেখিয়েছে পঞ্চগড়বাসীকে। করোনা মহামারীর কারণে সারাদেশের মানুষরা ছিল যখন ঘরবন্দি ঠিক তখনি উত্তরের পরিষ্কার আকাশে দেখা মিলেছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার। লাখো মানুষ ভিড় করেছিল পঞ্চগড়ে। বিশেষ করে তেঁতুলিয়ায় উপজেলা দুর দূরান্ত থেকে আগত মানুষদের পাদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছিল আবাসন ব্যবস্থা নিয়ে। এত লোকের রাত্রিকালীন থাকার জন্য সুবিধা ছিল একেবারে অপ্রতুল। এসময় এগিয়ে আসে উপজেলা প্রশাসন। তারা উপজেলার আশপাশের মানুষদের উদ্বুদ্ধ করে অতিথিদের জায়গা দেয়ার জন্য। যার বাড়িতে অতিরিক্ত থাকার ঘর রয়েছে বা যাদের দু’টি ঘর আছে তারা একটি ঘর ছেড়ে দেয় অতিথিদের জন্য। সেই বাড়িতে পর্যটকরা অবস্থান করে। আর তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় ওই বাড়িতেই। এক বা দু’রাত অবস্থানের পর পর্যটকরা যাওয়ার সময় কিছু টাকা দিয়ে যান। এভাবেই পঞ্চগড়ে উঁকি মারে কমিউনিটি ট্যুরিজমের। 

ভিতরগড় দুর্গনগরীর ২৫ কিলোমিটার এলাকায় রয়েছে অসংখ্য বসতবাড়ি। ভিতরগড়কে প্রত্নস্থল হিসেবে ঘোষণা করে এখানে কমিউনিটি ট্যুরিজমের ব্যবস্থা করলে ওই এলাকার অধিকাংশ মানুষ এই সুবিধা ভোগ করবে।  

এ নিয়ে কথা বললে ড. জাহান বলেন, প্রত্ন-পর্যটন হিসাবে ভিতরগড় অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ভিতরগড়ে পরিবেশ বান্ধব প্রত্ন-পর্যটন শিল্পের বিকাশ সাধন করা সম্ভব। দেশের মধ্যে বড় পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত ও সিলেট। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে উঠেছে অনেক ব্যক্তি মালিকানাধীন পর্যটন কেন্দ্র। যেগুলো অনেক পুরনো। পর্যটকরা সেগুলো বার বার দেখতে চায় না। তারা চায় নতুন নতুন জায়গা চিনতে ও দেখতে। প্রতিবছর শীত মৌসুমে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় লক্ষাধিক পর্যটক আসে। ভিতরগড়কে প্রত্ন পর্যটনস্থল হিসেবে গড়ে তোলা গেলে প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। 

তিনি বলেন, ভিতরগড়কে প্রত্ন পর্যটন হিসেবে গড়ে তুলতে সবার আগে উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। পর্যটকদের জন্য সব ধরণের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে দেশের পর্যটকরা তো বটেই; প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের পর্যটকরাও এখানে ভিড় করবে। 

তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার এলাকাটিকে সামগ্রিকভাবে পুরাকীর্তি আইনের আওতায় সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় সরকার একটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। সরকার উদ্যোগ নিলে ভিতরগড়ের প্রত্ন নিদর্শন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নেয়া সম্ভব।

Place your advertisement here
Place your advertisement here