• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

Find us in facebook
সর্বশেষ:
যুদ্ধের অর্থ জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যয় হলে বিশ্ব রক্ষা পেত- প্রধানমন্ত্রী দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড মেডিকেল কলেজের ক্লাস অনলাইনে নেয়ার নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ‘গণতান্ত্রিক রীতিনীতি না মানলে জনগণই বিএনপিকে প্রতিহত করবে’ লালমনিরহাটে হত্যা মামলায় বিএনপির দুই নেতা কারাগারে

পুলিশের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে সুন্দরবন থেকে ছয় কিশোর উদ্ধার       

– দৈনিক রংপুর নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৩০ মে ২০২০  

Find us in facebook

Find us in facebook

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি মিডিয়া মো. সোহেল রানা জানান, জয়, সাইমুন, জুবায়ের, মাঈনুল, রহিম ও ইমরান। তারা ছয় বন্ধু। বয়স ১৬ থেকে ১৭। ঈদ উপলক্ষে সুন্দরবনে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে তারা। যেই ভাবনা, সেই কাজ। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা গত বুধবার (২৭ মে) সকালে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগরে বেড়াতে আসে। বেড়াতে এসেই তারা হারিয়ে যায় গভীর জঙ্গলের ভেতরে।

এআইজি মিডিয়া মো. সোহেল রানা আরও জানান, বুধবার সকাল ১০টা। ধানসাগর লাগোয়া এলাকায় বনরক্ষীদের অফিস রয়েছে। পাশেই একটি ছোট খাল। খালের ওপাড়ে যাওয়ার জন্য একটি কাঠের পুল রয়েছে। পুলটি সাধারণ মানুষের জন্য নয়। সুন্দরবন পাহারা দিতে যাওয়া বনরক্ষীরা শুধু পুলটি ব্যবহার করেন। ছয় কিশোর লোক চক্ষুর অন্তরালে পুল পাড় হয়ে খালের ওপারে চলে যায়। এরপর গল্প করতে করতে তারা সুন্দরবনের ভেতরে হাঁটতে থাকে। সকাল গড়িয়ে দুপুর। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তাদের যে ফিরতে হবে, সেই ভাবনা-ই নেই। বিকেলে দূর থেকে ভেসে এলো আসরের আযানের শব্দ। এবার তাদের ফেরার কথা মনে হলো।

সোহেল রানা জানান, যে পথে তারা এসেছে, সেই পথে উল্টো দিকে কিছু দূর হাঁটল। এরপর পথ হারালো তারা। বেরিয়ে আসার পরিবর্তে উল্টো বনের গহীণে যেতে লাগল। এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। বেরুনোর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিল না তারা। তাদের সঙ্গে ছিল তিনটি মোবাইল ফোন। তাতে নেটওয়ার্ক আসে যায় অবস্থা। এক পর্যায়ে মোবাইল ফোনে পরিবারকে নিজেদের দুর্দশার কথা জানায় কিশোররা।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি জানান, হারিয়ে যাওয়াদের দলের একজন বুদ্ধি করে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ ফোন করে। এরপর শরণখোলা থানার সঙ্গে তাকে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। এদিকে নৌ-পুলিশকেও বিষয় অবহিত করা হয়। নিজেদের সমস্যার কথা জানিয়ে কিশোর তাদেরকে উদ্ধারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশের কাছে অনুরোধ জানায়। খবর পাওয়া মাত্রই পুলিশ উদ্ধার অভিযানে নেমে পড়ে। কিন্তু এতবড় সুন্দরবনে কারও অবস্থান জানা তো সহজ সাধ্য নয়। অন্যদিকে, কিশোররা বনের ঠিক কোন অংশে থেকে হারিয়ে গেছে,সেটিও  নির্দিষ্ট করে বলতে পারছিল না।

তিনি জানান, ইতিমধ্যে ওই কিশোরদের সঙ্গে থাকা দুটি ফোন চার্জের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। সচল থাকে শুধু একটি ফোন। সেটির মাধ্যমেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল পুলিশ। কিশোরদের বনের মধ্যে হাঁটা-চলা না করে গাছে চড়ে বসার জন্য পরামর্শ দেয় পুলিশ। কারণ সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ওই অংশে বাঘের চলাচল আছে।
পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, উদ্ধার অভিযান শুরু করার কিছু সময় পরই শুরু হলো বৃষ্টি। এতে বনের মধ্যে এক গুমোট অন্ধকারের সৃষ্টি হলো। অন্ধকার পরিবেশে আরও ভড়কে গেল কিশোররা। এরমধ্যেই তাদের সঙ্গে থাকা সচল ফোনটিরও নেটওয়ার্ক চলে গেল। এদিকে, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যায় পুলিশ।

তিনি জানান, এক পর্যায়ে কিশোরদের ফোনে নেটওয়ার্ক ফিরে আসায় পুলিশ তাদের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। কথা বলার এক পর্যায়ে তারা জানায়, মাইকে এশার আজানের শব্দ শুনেছে তারা।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি জানান, কিন্তু সুন্দরবনের ওই এলাকার পাশের লোকালয়ে দুই পাশে দুটি মসজিদ আছে। কাজেই, কোন মসজিদের মাইকের আজানের শব্দ শুনতে পেল, সেটি জানতে পারলে তাদের অবস্থানের ব্যাপারে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে। এবার একপাশের মসজিদের মাইক দিয়ে তাদের ডাকা হলো। আর মোবাইল ফোনে জানতে চাওয়া হলো, আওয়াজ শোনা যায় কিনা? জবাব এলো, খুবই কম। এবার বনের অন্য পাশের মসজিদের মাইক দিয়ে ডাকা হলো। এবার মোবাইল ফোনে কিশোরেরা জানালো, তুলনামূলক স্পষ্ট শব্দ শুনতে পাচ্ছে তারা। এটার মাধ্যমে বনের মধ্যে তাদের অবস্থানটি কিছুটা আঁচ করে নিলো পুলিশ।

সোহেল রানা জানান, সুন্দরবনের ভেতরে স্বাভাবিকভাবে ৩-৪ কিলোমিটার পর্যন্ত শব্দ শোনা যায়। আর রাতে সেটি আরও গহীন থেকে শোনা যায়। তাই, পুলিশ সুন্দরবনের ৪-৫ কিলোমিটার ভেতরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে এগুতে থাকে।  সুন্দরবনের ভেতর হাঁটা সহজ নয়। কেওড়ার শ্বাসমূলের সঙ্গে লতাগুল্ম। ঝোপঝাড় আর নানা ধরনের কাঁটা। রাতের অন্ধকারের সাথে বৃষ্টি। পিচ্ছিল পথে এ এক কণ্টকাকীর্ণ যাত্রা। কয়েক ঘণ্টা ধরে সেই পথ পাড়ি দিয়ে বনের আরও ভেতরে গেল পুলিশ। এবার মোবাইল ফোন ওই কিশোরদের পুলিশ বলল, আমরা হাঁক তুলব। শুনতে পেলে তোমরাও হাঁক তুলবে। পুলিশ বনের মধ্যেই হাঁটতে হাঁটতে হাঁক তুলল। কিন্তু ওই পাশ থেকে সাড়া নেই।

পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, ঘণ্টা খানেক পর ওপাশ থেকেই হাঁকের জবাব এলো। এবার পুলিশ বুঝতে পারল, কাছাকাছি চলে এসেছে তারা। হাঁক দিতে দিতে একসময় হারিয়ে যাওয়া কিশোরদের খুঁজে পায় পুলিশ। ততক্ষণে রাত তিনটা বেজে গেছে।  দীর্ঘক্ষণ বনের মধ্যে এমন প্রতিকূল পরিবেশে থেকে মুষড়ে পড়েছে কিশোররা। পুলিশ ধরাধরি করে তাদের নিয়ে থানায় ফিরতে ফিরতে রাত পেরিয়ে ভোর। অনেকক্ষণ কিছু না খেতে পেরে আরও ক্লান্ত কিশোরেরা। থানায় এনে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের পাশাপাশি খাবার খেতে দেয় পুলিশ। এরপর সকালে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কিশোরদের স্ব স্ব পরিবারের সদস্যদের হাতে তুলে দেয় পুলিশ।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি জানান, সন্তানদের ফিরে পেয়ে পরিবারের সদস্যদের চোখে তখন আনন্দাশ্রু। বুকে সন্তান জড়িয়ে বাংলাদেশ পুলিশের জন্য প্রাণভরে দোয়া করলেন তারা। জানালেন অশেষ কৃতজ্ঞতা।

তিনি জানান, থানা থেকে বিদায়বেলা হারিয়ে যাওয়া দলের এক কিশোর থমকে দাঁড়াল। পুলিশকে লক্ষ্য করে বলল, ‘বনের ভেতরে যখন হারিয়ে গিয়েছিলাম, তখন বারবার মনে হয়েছে এ জীবনে আর ফেরা হবে না। কিন্তু পুলিশের কারণে আমরা ছয়জন আবার নতুন জীবন পেলাম। আমি পড়াশোনা করে পুলিশ হতে চাই। বিপদে এভাবেই মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই।’

Place your advertisement here
Place your advertisement here